টাঙ্গাইলে চাঞ্চল্যকর ফারুক হত্যা মামলার রায় দুজনের যাবজ্জীবন খান পরিবারের সবাই খালাস
জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ এক যুগ পর টাঙ্গাইলের ব্যাপক চাঞ্চল্যকর আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহম্মেদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছেন- মোহাম্মদ আলী ও কবির হোসেন। তারা জামিনে গিয়ে পলাতক রয়েছেন। বহুল আলোচিত ওই মামলার রায় দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহমুদুল হাসান জনাকীর্ণ আদালতে ওই রায় ঘোষণা করেন।
মামলায় খালাস প্রাপ্তরা হচ্ছেন- টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা, তার ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহেদুর রহমান খান কাকন ও কেদ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সোনিয়াত খান বাপ্পা, বাবু সওদাগর, আলমগীর হোসেন চাঁন, নাছির উদ্দিন নুরু, ছানোয়ার হোসেন ছানু, মাসুদুর রহমান মাসুদ এবং ফরিদ আহম্মেদ। মামলা চলাকালে অপর দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা ও মোহাম্মদ সমীর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এরআগে এদিন দুপুর ১২টার দিকে রায় ঘোষণা করতে গেলে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল বাঁধে। পরে একই দিন বিকাল ৩টার দিকে আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহমুদুল হাসান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মোহাম্মদ আলী ও কবির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্ত টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
টাঙ্গাইলের সর্বাধিক আলোচিত-সমালোচিত এ রাজনৈতিক হত্যা মামলা নিয়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে সারা বছর পক্ষে-বিপক্ষে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে। সাক্ষীরা সাক্ষ দিতে নানা অযুহাতে বিস্তর সময় নিয়েছেন।
সহিদুর রহমান খান মুক্তি অন্য একটি মামলায় জেলহাজতে থাকায় সেখান থেকে তাকে আদালতে আনা হয়। রায় ঘোষণার পরে আবার তাকে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। খালাসের পরে সহিদুর রহমান খান মুক্তি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি ন্যায় বিচার পেয়েছি। এজন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাছির উদ্দিন খান নাছির জানান, আদালত ন্যায় বিচার করেছেন। রায়ে আমরা খুশি। যে সময় ঘটনা দেখানো হয়েছে- ওই সময় টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ঘাটাইলের একটি সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন, টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি চিকিৎসার্থে স্বস্ত্রীকে ভারত, জাহিদুর রহমান খান কাকন ব্যবসায়িক কাজে মালয়েশিয়াতে অবস্থান করছিলেন এবং সোনিয়াত খান বাপ্পা জেলা ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। চারজন সাক্ষী তাদের জবানীতে সোনিয়াত খান বাপ্পা তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ কার্যালয়ে তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত কৌঁসুলি (এপিপি) মোহাম্মদ সাইদুর রহমান জানান, মামলার রায়ে আদালত দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস দিয়েছেন। তারা বাদি পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ তার কলেজপাড়ার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার তিন দিন পর ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদ টাঙ্গাইল সদর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি জেলা গোয়েদা পুলিশ (ডিবি) তদন্তের দায়িত্ব পায়। ২০১৪ সালের অগাস্টে হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গোয়েদা পুলিশ (ডিবি) আনিসুল ইসলাম রাজা ও মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে আওয়ামী দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, তার ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন এবং কেদ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সোনিয়াত খান বাপ্পার নাম উঠে আসে।
পরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াহেদ, আবদুল খালেক এবং সনি আদালতে জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতেও ওই চারজনের নাম উঠে আসে। এরপর ওই চার ভাই আত্মগোপনে চলে যান। এক পর্যায়ে আমানুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি তিন বছর পর জামিনে মুক্ত হন। ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিবির তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মাহফীজুর রহমান খান পরিবারের চার ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।
মামলার অভিযুক্ত আসামি আমানুর রহমান খান আত্মসর্মপণের পর তিন বছর কারাগারে থাকার পরে বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার অপর ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান এখনও কারাগারে আছেন। অন্য দুই ভাই জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সোনিয়াত খান বাপ্পা মালয়েশিয়াতে পলাতক রয়েছেন। বিচার চলাকালে দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা এবং মোহাম্মদ সমীর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। সবশেষ ২৬ জানুয়ারি আলোচিত ফারুক হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়।
এদিকে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে আমানুর রহমান খান আবার আত্মগোপনে চলে যান। তার অপর দুই ভাই ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া আমানুরের আরেক ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি অন্য একটি মামলায় কারাগারে আছেন। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, স্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। তবে কোনো মামলায় তাদের বিচার হয়নি।
আমানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। সহিদুর রহমান খান মুক্তির বিরুদ্ধেও পাঁচটি হত্যাসহ অন্তত ৪০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া জাহিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা এবং সোনিয়াত খান বাপ্পার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা হয়েছে। এত মামলা হলেও তাদের কখনও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখনও তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। আবার কখনও আসামিদের চাপে বাদীপক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ভয়ে কেউ কখনো আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে যায়নি।
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।