রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

টাঙ্গাইলে কৃষি জমি কমলেও বাড়ছে ফসল উৎপাদন

জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রভাবে টাঙ্গাইলের কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। কিন্তু কৃষি বিভাগের তৎপরতায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাষে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করায় ফসল উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে। জানাগেছে, বর্ধিত সংখ্যার জন্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে জেলায় দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। অনেক ক্ষেত্রে জলাভূমি ভরাট করেও নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে জেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৯ হেক্টর। এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ দুই লাখ ৪০ হাজার ৬৫৯ হেক্টর। যা গত বছরের তুলনায় এক বছরে এক হাজার ৪২০ হেক্টর ফসলি জমির পরিমাণ কমেছে। এসব জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আখ, বাদাম, কলা, পেঁপে, লেবু প্রভৃতি সহ নানা জাতের সবজি ও ফল-ফলাদী চাষ হয়ে থাকে।

টাঙ্গাইল জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কৃষি শুমারি ২০০৮ এবং কৃষি শুমারি ২০১৯ এর কৃষি খানার মালিকানার ক্ষেত্রে নিজস্ব জমি আছে এমন খানার সংখ্যা ২০০৮ অনুযায়ী পাঁচ লাখ ১১ হাজার ৬৪৯। অথচ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারিতে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত লাখ ৯ হাজার ৬৭২। নিজস্ব জমি আছে এবং অন্যের জমিও তার পরিচালনাধীন এ রকম খানার সংখ্যা ২০০৮ এ ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার ১৫৪ এবং ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪০৯। নিজস্ব জমি নেই শুধু অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে এরকম খানার সংখ্যা ২০০৮ অনুযায়ী ৫৭ হাজার ৮৩৪টি- যা ২০১৯ সালে কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ৬৫৩টি।একই সূত্রমতে, ২০২২ সালে জেলার মোট গণনাকৃত জনসংখ্যা ৪০ লাখ ৩৭ হাজার ৬০৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ২জন ও নারী ২০ লাখ ৯০ হাজার ৯৮২জন। অথচ ২০১১ সালে জেলায় মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ পাঁচ হাজার ৮৩ জন। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী জেলার পল্লি ও শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার যথাক্রমে ৭৭.৪০% ও ২২.৬০%। এ হার ২০১১ সালে ছিল পল্লিতে ৮৪.৯২% এবং শহরে ১৫.০৮%।

কৃষি বিভাগ জানায়, হারিয়ে যাওয়া কৃষি জমির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষিবান্ধব নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি জমি কমে যাওয়ায় একদিকে ফসলের অধিক উৎপাদন ও অপরদিকে এক ফসলি জমিকে একাধিক ফসলে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনারই আধুনিকায়ন করতে তারা তৎপরতা চালাচ্ছেন।

কৃষকরা জানায়, গ্রামাঞ্চলে দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। একান্নবর্তী পরিবার ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমির ওপর এর প্রভাব পড়ছে। এক বাবার চার সন্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া অনেকে চাকুরির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি জমির প্রয়োজনবোধ করছেন না। এরপরও কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল তো রয়েছেই। নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রতিবছর সহস্রাধিক হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। যোগাযোগ, আবাসন ও নির্মাণকাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষি জমি।

চরাঞ্চলের কৃষক কেরামত আলী, আব্দুল মালেক, রহমান সেখ, ইসমাইল হোসেন সহ অনেকেই জানান, বর্তমানে চরাঞ্চলে বাদাম ও কলার চাষ বেশি হচ্ছে। চরাঞ্চলে আগে বিভিন্ন সবজির আবাদ হতো। কলা ও বাদাম চাষে কৃষকের খরচ কম- লাভ বেশি। ফলে চরাঞ্চলের কৃষকরা সবজি আবাদ ছেড়ে অনেকেই কলা ও বাদাম চাষে ঝুঁকছেন। এছাড়া স্থানীয় তিন ফসলি আবাদী জমিতে কতিপয় মাটিখেকো মাটি কেটে কেটে বিক্রির বিরূপ প্রভাব ফসলি জমিতে পড়ছে। তারা মনে করেন, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালা, খাল-বিল থেকে মাটি কেটে বিক্রির মচ্ছ্বব শুরু হয়। এ অবস্থার অবসান না করা হলে ‘ফসলি জমি’ হুমকিতে পড়বে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা বেল্লাল হোসেন জানান, আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও কৃষি বিভাগের নানামুখি তৎপরতায় নানা জাতের ফসলের আবাদ বাড়ছে। প্রতিবছর মিল-কারখানা গড়ে ওঠায় এক থেকে দেড় ভাগ ফসলি জমি কমছে। তবে জেলার কৃষকরা অত্যাধুনিক ভিন্ন ভিন্ন প্রদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। ফলে ফসলি জমি কমলেও ফসল উৎপাদন বাড়ছে।

টাঙ্গাইল জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক(ভারপ্রাপ্ত) মো. ওবায়দুর রহমান জানান, নিজস্ব জমি আছে জেলায় এমন খানার সংখ্যা ২০০৮ এর তুলনায় ২০১৯ সালে ৩৮.৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন শুমারির উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে জেলার শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার ছিল ৭.৫৬% যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ২২.৬০% এ দাঁড়িয়েছে। অথচ দেশে শহর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার হার ৩১.৬৬%।

তিনি জানান, জেলার ৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৬ দশমিক ১৪ শতাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। জেলার ৫ এবং ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট জনগোষ্ঠীর যথাক্রমে ৩১ দশমিক ২২ শতাংশ ও ৩৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এ হিসেবে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে- এটা প্রতীয়মান।

জেলা সদরের কুমুদিনী সরকারি কলেজের সমাজ কল্যাণ বিভাগের প্রধান ডক্টর আজাদ জানান, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে- তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাটি বিধ্বংসী ভেকু (খননযন্ত্র) মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করায় ২-৩ ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে।

তিনি জানান, মধুপুর, ঘাটাইল ও মির্জাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইটভাটা ও মাছের প্রজেক্ট করতে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও মাছ চাষ একটি অর্থকরী প্রজেক্ট তারপরও ফসলি জমি বিনষ্ট করে মাছের প্রজেক্ট করা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক কবীর হোসেন জানান, জেলায় দু’ফসলি জমির পরিমাণ বেশি। দু’ফসলি জমিতে চার ফসলের আবাদ বাড়াতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আগে যেখানে এক ফসলি জমি ছিল- এখন সেখানে দু’ফসল আবাদ হচ্ছে। এইভাবেই জেলায় জমির পরিমাণ কমলেও ফসলের আবাদ বাড়ছে। এছাড়া দেশের অন্য জেলার তুলনায় এ জেলায় আবাদী জমির পরিমাণ কমেনি।

তিনি জানান, জেলার কৃষকরা এক ফসল চাষ করে পুনরায় ওই একই জমিতে অন্য ফসল চাষ করায় ফলন ভালো হচ্ছে। জেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলেও কৃষকরা ভালো ফসল ফলাচ্ছেন।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, জেলায় নদী-নালা ও খাল-বিল সহ কৃষি জমির ঊর্বরতা বিনষ্ট করে এমন সকল কাজ নিরুৎসাহিত করা হবে। যারা অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করেন- তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ দেখভাল করবেন। তাছাড়া, কৃষি প্রদাধ দেশ হিসেবে ফসল উৎপাদনের দিকে জেলা প্রশাসনের অবশ্যই আলাদাভাবে নজর থাকবে।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়