সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

অনলাইন জুয়া: হুমকির মুখে তরুণ প্রজন্ম

সংবাদের আলো ডেস্ক: প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পৃথিবীতে যতগুলো অসামাজিক কাজ চলে আসছে তার মধ্যে অন্যতম জুয়া। ধারণা করা হয় এই জুয়ার উৎপত্তি প্রস্তর যুগ থেকেই। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে বর্তমান সিরিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন জায়গায় পাশা খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চীন দেশেও পশু লড়াইয়ের উপর বাজি ধরার ব্যাপক প্রচলন ছিল বলে ধারণা করা হয়। হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ মহাভারত থেকে জানা যায়, জুয়া খেলে নিজেদের সর্বস্ব হারিয়েছিল পান্ডবরা। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, আধুনিক জুয়ার সর্বপ্রথম আসর বসে ইতালির ভেনিসে ১৬৩৮ সালে। এছাড়াও, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও জুয়া খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তখনকার অধিকতর অভিজাত মানুষ ঘৌড়দৌড়ে বাজি ধরতো।
তবে, বর্তমানে এই জুয়া এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও জুয়ার একটি বড় বাজার রয়েছে। ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিকভাবে জুয়ার এই বাজারের আকার ৪৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। যদিও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জুয়া খেলা আইনগতভাবে অবৈধ। তবুও এটি চলছে এবং দিন দিন এর প্রভাব বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে জুয়া প্রতিরোধে ব্রিটিশ আমলের ‘দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৮৭’ নামে একটি আইনের প্রচলন রয়েছে। ২০২৩ সালে এ আইনটিকে যুগোপযোগী করা জন্য একটি উদ্যোগও নেয়া হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘জুয়া আইন ২০২৩’ এর খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ করলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি আইনটি।
বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও ক্লাব কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে জুয়ার আসর বসানো নতুন কিছু নয়। তবে,  বর্তমানে বাংলাদেশে জুয়ার নতুন এবং আধুনিকতম সংস্করণ ‘অনলাইন জুয়া’ ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। অনলাইন জুয়ার বদৌলতে দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ পাচার হচ্ছে বিদেশে। সম্প্রতি অনলাইন জুয়া কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনলাইন জুয়ার ভয়াল থাবার প্রধান শিকার হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিশোর ও তরুণরা। একসময় গ্রামগঞ্জে জুয়া সীমাবদ্ধ ছিলো তাস, লুডু কিংবা ক্যারামে। তবে বর্তমানে গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ উঠতি বয়সী তরুণরাও আসক্ত হচ্ছে জুয়ার এই মারণ নেশায়। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন তারা।
অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে কেউ জীবন দিয়েছে, কেউ জীবন নিয়েছে আবার কেউ জমি-জমা বিক্রি করে সর্বস্ব হারিয়েছেন। ভার্চুয়াল জগতে ক্যাসিনো বলতে আমরা বুঝি রুলেট, ব্ল্যাকজ্যক এবং স্লট মেশিনের মতো গেমগুলোকে। তবে বর্তমানে প্রযুক্তির অপব্যবহারে অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে জুয়া। ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলসহ প্রায় সব খেলায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে এ ধরনের জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। তাছাড়া জুয়ার এই সংস্করণের সবচেয়ে ভয়াল খেলা যেটাকে বলা হয় তা হচ্ছে ক্যাসিনো। এছাড়াও পোকার ও অন্যান্য তাস জাতীয় খেলাগুলোর মাধ্যমেও এটি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে।’
বর্তমানে অনলাইন জুয়া সহজলভ্য হওয়ায় এটিতে আসক্তির ঝুঁকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এ আসক্তি আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক সব দিকেই ক্ষতি করে থাকে। অনলাইন জুয়ার সামাজিক প্রভাব বহুমাত্রিক হতে পারে। এটি যেমন ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি সামাজিক পরিসরেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখা যায়। যেভাবে অনলাইন জুয়া ব্যক্তির সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে তাহলো-
১) অর্থনৈতিক প্রভাব:
জুয়ায় অংশগ্রহণ বা আয়ের ক্ষেত্রে কোন সীমা নেই। এতে যেমন মুহূর্তেই ধনসম্পদ অর্জন হয় তেমনি মুহূর্তেই সর্বস্ব হারাতেও হয়। এখন পর্যন্ত জুয়ার থাবায় দেউলিয়া হয়ে সর্বস্ব হারানো লোকের সংখ্যাই বেশি। অনলাইন সাইটগুলোর গেম থিওরির কারণে একজন জুয়ারির ক্রমাগত সফলতার সম্ভাবনা খুবই কম। এতে মাঝে মাঝে একজন জুয়ারি জিতলেও অধিকাংশ সময় তারা হেরে যান। আর এতেই লাখ লাখ টাকা হারিয়ে পথে বসতে হয় তাকে। জুয়ায় আসক্ত একজন ব্যক্তি অতিরিক্ত পরিমাণ বাজি ধরলে এবং হেরে গেলে তার এবং তার পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা দেয়। বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুয়ার ভয়াল থাবার খপ্পরে পড়ে দারিদ্র ও ঋণের পরিমাণও বেড়ে যায়।
২) মানসিক স্বাস্থ্য:
একজন মানুষের মানসিক অবস্থা তার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ’। অনলাইন জুয়া মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়। অনেক সময় জুয়ায় আসক্তির ফলে বিষণ্নতা এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
৩) পারিবারিক সম্পর্ক:
অনলাইন জুয়া পারিবারিক সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি পরিবারের প্রতি মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হতে পারে। তাছাড়া আর্থিক ক্ষতির কারণে পরিবারের ওপর সামাজিক চাপে পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের অবনতির ঘটনাও ঘটে। এছাড়াও অনেক সময় দেখা যায় জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে খুনের মতো ঘটনাও ঘটে। গত কয়েক বছরে দেশের গণমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যায় জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি টাকার জন্য পরিবারের সদস্যদের খুন করতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
৪) অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড:
আসক্ত ব্যক্তি অর্থের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে নানারকম অসামাজিক এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। চুরি, প্রতারণার মাধ্যমে সে জুয়া খেলার অর্থ জোগাতে সচেষ্ট হয়। এতে সমাজে অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়।
৫) প্রজন্মগত প্রভাব:
অনলাইন জুয়ার প্রভাব প্রজন্মগতভাবে পরবর্তী প্রজন্মের উপরও পড়ে। যদি পরিবারের কোন একজন সদস্য জুয়ায় আসক্ত হয় তবে তার প্রভাব পরিবারের শিশু-কিশোরদের ওপরও পড়তে পারে। তাছাড়া এটি তাদের মনোভাব ও আচরণের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়