বুধবার, ৩০শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

আনার ছাত্রজীবন থেকে যেভাবে স্বর্ণ চোরাচালানের ডন

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে তার উত্থান, স্বর্ণ চোরাচালান, খুনখারাবিসহ নানা অপরাধের বিষয় উঠে আসছে। রহস্য দেখা দিয়েছে তার হত্যাকাণ্ড ঘিরে। উঠছে নানা প্রশ্নও। তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটি বিষয় সবাই জানতে চায়। কে এই এমপি আনার, তাকে ঘিরে এত আলোচনা কেন? দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারাদের রাজত্ব ছিল। সেই রাজত্বের মধ্যে এমপি আনারের উত্থান। তার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আকতারুজ্জামান শাহীন। আর হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমান উল্লাহ। এলাকাবাসীর কাছ থেকে এবং স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপি আনার ছাত্রজীবন থেকে ২৩টা মোটরসাইকেল নিয়ে চলতেন। নিজে চালাতেন লাল রঙের একটি মোটরসাইকেল। অন্য ২২টি মোটরসাইকেলে চোরাচালানের সামগ্রী বহন করত তার নিয়োজিত কর্মীরা। তারা ছিল বেতনভুক্ত। এক জন আনারের পেছনে বসে থাকত। তার সঙ্গে চোরাচালানির মালামাল থাকত। তার প্রতিটি গাড়িতে নম্বর থাকত। এই নম্বর দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ছেড়ে দিত। কারণ আনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে টাকা দিতেন।
আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। টানা তিন বার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এলাকাবাসী জানান, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চরমপন্থিদের আশ্রয় ও হত্যাসহ ২২টি মামলা ছিল। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তা নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদের স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানির টাকার ভাগ অনেকে পেতেন। যাদের বাবা ছিলেন শ্রমিক ও দিনমজুর এখন তারা হাজার কোটি টাকার মালিক। তারা দলীয় নেতা সেজে রয়েছেন। অনেকেই স্বীকৃত রাজাকারের সন্তান।’
১৯৮৪ সালে এমপি আনার এসএসসি পাশ করেছে। ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। আর সরকারি মাহতাবউদ্দিন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন ১৯৮৮ সালে। এইচ এম এরশাদের সময় স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান। মাইক্রোবাসে করে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা থেকে স্বর্ণ নিয়ে যেতেন সীমান্তবর্তী এলাকায় আর মাদক নিয়ে আসতেন ঢাকায়। আনারের এলাকায় তারই একক আধিপত্য ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমে কালিগঞ্জ পৌর মেম্বার ছিলেন। দুই বার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্তপথে চোরাচালান করতেন তিনি। ঐ সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ঐ টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ২০০৯ সালে এমপি আনার উপজেলার চেয়ারম্যান হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে এমপি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির আগে তিনি এরশাদের জাপা করতেন। এরপর বিএনপির রাজনীতি করতেন।
চরমপন্থি লাল দলের প্রধান বলে পরিচিত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ডা. টুটুলকে ২০০৯ সালে রেব তুলে নিয়ে যায়। নেওয়ার পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় নওগাঁওয়ের গোদাগাড়ি এলাকায়। ঐ সময় তার পরিবার সন্দেহ করেছিল, এমপি আনার লাল দলের প্রধান ডা. টুটুলকে র‍্যাবের হাতে তুলে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। নিহত টুটুল হলেন এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের আপন চাচাতো ভাই। আর এমপি আনার হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়ার আপন ভগ্নীপতি। এই কারণে শাহীন ও শিমুল আগে থেকেই এমপি আনারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। শিমুলকে র‍্যাব দিয়েও মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এমপি আনার। সে পালিয়ে নিজেকে বাঁচায়। শাহীন ও শিমুলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল এমপি আনারের ওপর। এরপর ৫০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধে মাফিয়া চক্র ও শাহীনের সঙ্গে। কয়েক জন বড় ব্যবসায়ী ও দুই জন সাবেক এমপি এই মাফিয়া চক্রে রয়েছেন। তবে এককভাবে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এমপি আনার। মাফিয়ারা শাহীনকে দিয়ে তার ফুপাতো ভাই শিমুল ভুঁইয়াকে কাজে লাগায় এমপি আনার হত্যাকাণ্ড ঘটাতে। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ডা. টুটুল হত্যাকাণ্ডও একটি কারণ।’
ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার এমপি আনারকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ঐ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার। ১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের পাশাপাশি কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারেও জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েক জন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত।
এর ১০ দিন পর ঐ বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার। অনেকেই বলে থাকেন ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত মাফিয়াদের কাছে যত টাকা, তারা নিজেরাই বাজেট দিতে পারে। দেশ-বিদেশে তাদের বিপুল সম্পদ।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----