বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

১ হাজার টাকা তোলার জন্য ১৫ দিন ধরে ঘুরতেছি

সংবাদের আলো ডেস্ক: ইতালি প্রবাসী আফসার উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে তার প্রায় ৭ লাখ টাকার বেশি জমা রয়েছে। ব্যাংকটির মতিঝিলের প্রিন্সিপাল শাখায় এক মাসের মধ্যে তিনি তিনবার এসেও ওই টাকা ওঠাতে পারেননি। কবে নাগাদ টাকা দিতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। এমনকি শাখা ম্যানাজারকেও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। প্রায় একই চিত্র আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অন্য শাখাগুলোয়ও, তীব্র তারল্য সংকটের কারণে কোনো শাখাই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
শুধু আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক-ই নয়, সরকারি ও বেসরকারি খাতের আরও কিছু সংকটাপন্ন ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা যথাসময়ে ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত দুর্বল ৫টি ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়ার পর আতঙ্ক ও ভীতি থেকে সাম্প্রতিক সময়ে সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেয়ার ঘটনা বেড়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বেসিক ব্যাংক থেকেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নেয়া হয়েছে। সবমিলে এক মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একীভূতকরণ আতঙ্ক ও আস্থা সংকটে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেয়া হয়েছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও আমানত ভাঙার প্রবণতা বেড়েছে। একই কারণে কমে গেছে নতুন আমানত আসাও। এতে সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে: গতকাল রোববার দুপুর ২টার কিছু আগে মতিঝিলের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের শাখায় গ্রাহক সেজে এই প্রতিবেদক টাকা তুলতে গেলে একজন নারী কর্মকর্তা জানান, তাদের ক্যাশে সমস্যা আছে। এখন টাকা তোলা যাবে না। শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, ম্যানেজার বাইরে গেছে। কখন আসবে জানি না। তবে এ শাখায় সিকিউরিটি গার্ড জানায়, ম্যানেজার অফিস করেন না। গ্রাহকরা টাকা তোলার জন্য আসে। তিনি টাকা দিতে না পেরে অফিসে আসা বিরত রাখছেন।
একই শাখায় সকাল থেকে ব্যাংকে ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষারত ব্যাংকের গ্রাহক শাহিনুর এবং কাদের মোল্লা। তারা দুজনই বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যাংকে আসছেন তাদের টাকা তুলতে। কিন্তু ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। তাই তারা ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। ব্যাংকটির গ্রাহক শাহিনুর বলেন, ‘আমি ১ হাজার টাকা ওঠাবো ব্যাংক থেকে কিন্তু এটা পারছি না। ব্যাংক আমাকে টাকা দিতে পারছে না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন ব্যাংকে নাকি টাকা নাই। আমরা ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ নেই।’ কতদিন ধরে ১ হাজার টাকা তোলার জন্য আসছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এ গ্রাহক বলেন, ‘আমি ১৫ দিন ধরে আসছি কিন্তু তারা কোনো টাকা দিতে পারছে না। আমার সহকর্মী কাদের মোল্লা ভাই ১০ হাজার টাকার জন্য প্রায় এক মাস সময় ধরে ব্যাংকে আসছেন কিন্তু তিনি টাকা পাচ্ছেন না। ব্যাংকে নাকি টাকা  নেই।’
শুধু মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখা-ই নয়, ব্যাংকটির নয়াপল্টন ভিআইপি শাখায় একই চিত্র দেখা যায়। এই শাখায়ও বেশ কিছুদিন ধরে টাকা উত্তোলনের জন্য ম্যানেজারের পেছনে ঘুরছেন কয়েকজন গ্রাহক। এ শাখায় আসা জাকির হোসেন নামে একজন গ্রাহক গত বৃহস্পতিবার জানান, ব্যাংকের ভল্টে টাকা নেই, তাই ম্যানেজার কেবল আশ্বাসই দিচ্ছেন। গত ঈদের আগে এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আসে। ব্যাংক থেকে আজ-কাল বলে শুধু ঘুরাচ্ছে। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না। এমনকি ৫ হাজার টাকা চাইলাম সেটাও দিতে পারল না। আক্ষেপ করে আরেক গ্রাহক গোলাম মোস্তফা বলেন, ১০ বছর ধরে আমার অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকে। কুমিল্লা থেকে ৪ লাখ টাকা পাঠিয়েছে এক ক্লায়েন্ট। তাকে বললাম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা না পাঠাতে। কিন্তু সে টাকা পাঠিয়ে আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছে। তিনি বলেন, ৫০ হাজার টাকা তুলতে এসেছি। কিন্তু টাকা দিতে পারছে না।
শুধু জাকির বা মোস্তফা নন, গত সপ্তাহে ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখার গ্রাহক আব্দুল হামিদ মাহবুব টাকা তুলতে গেলে তাকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি। ওই শাখায় তার এক লাখ টাকা জমা রয়েছে। গত মঙ্গলবার সকালের দিকে ওই ব্যাংকের নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য চেক নিয়ে গেলে তাকে টাকা না দিয়েই ফিরিয়ে দেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে জানান, ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তিনি ওই চেকের ছবি দিয়ে তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দেন। এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান। মিটিং শেষে কল দেয়ার কথা থাকলেও আর কল দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তারল্য সংকটের কারণে পদ্ধতিগত ঝুঁকিতে রয়েছে আইসিসি ইসলামিক ব্যাংক। দ্রুততম সময়ে নতুন মূলধন যোগান ছাড়া ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, তীব্র তারল্য সংকটে পড়ে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে আবেদনের দুই সপ্তাহ পরে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ, এটি তারল্য সংকটের কারণে কার্যত বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষের দিকে ব্যাংকটি ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পরে। তাদের মোট ৭৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণের ৮৭ শতাংশই খারাপ ঋণ।
এদিকে, বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া পদ্মা ব্যাংক গ্রাহকের টাকা দিচ্ছে কিস্তিতে। গতকাল ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা টাকার জন্য অপেক্ষা করছেন। গ্রাহক টাকা তোলার চাহিদা দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদার অর্ধেক দিচ্ছেন। বাকিটা পরবর্তীকালে নেয়ার জন্য বলা হয়। ওই শাখার ম্যানেজার মনির হোসেন বলেন, গ্রাহক টাকা তুলতে এলে ফেরত যাচ্ছে না। তবে যা চাহিদা তার অর্ধেক বা তার চেয়ে কম দিচ্ছি। তিনি বলেন, একীভূত হওয়ার খবর টাকা তোলার একটা চাপ ছিল। এখন তা অনেকটা কমে গেছে। তবে ব্যাংকটির গ্রাম পর্যায়ের বিভিন্ন শাখায় টাকা দিতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জানতে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবরে ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা ইতোমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংকও চরম তারল্য সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে টাকা ধার পাচ্ছে না, আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ কোনো সহায়তা করছে না। ফলে গ্রাহকদের টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাংক যেকোনো মুহূর্তে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুর রহমান। এর বাইরে একীভূতকরণ আতঙ্কে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) থেকেও আমানত তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী: গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে। এই প্রবৃদ্ধি গত ৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো মাসেই আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। ফেব্রুয়ারিতে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----