শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

টাঙ্গাইলে মধু আহরণে সরিষার ফলন ও চাষ বাড়ছে

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলে বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করায় দিন দিন সরিষার আবাদ ও ফলন দুই-ই বাড়ছে। জেলায় আহরিত মধু যাচ্ছে বিদেশে- সৃষ্টি হচ্ছে নয়া কর্মসংস্থান। এ বছর জেলায় ২৩ হাজার ৪২০ হেক্টরের বেশি জমিতে সরিষার আবাদ বেশি হওয়ার পাশাপাশি ১১২ জন মৌচাষি ৬ হাজার ৫৯৭টি বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করছেন। ফলে সরিষার ফলন ৩০-৪০ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা যায়, চলতি সরিষার মৌসুমে মৌচাষিরা ছয় কোটি টাকার মধু আহরণের আশা করছেন। মধু আহরণকে কেন্দ্র করে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন ত্বরান্বিত হওয়ায় বিঘাপ্রতি সরিষার ফলন বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

জেলার আহরিত মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন ফুলের বাগান, সরিষা, তিল, কালিজিরা, ধনিয়া ক্ষেত থেকে মৌচাষিরা মধু আহরণ করে থাকেন। সরকারি পর্যায়ে বিসিক মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ায় দেশের মৌ ফসল এলাকা থেকে বাণিজ্যিকভাবে মধু আহরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফুল থেকে আহরিত মধুর রং ও স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে দামও ভিন্ন। তাদের আহরিত মধু দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানী করা হচ্ছে।

ভারত গেল বছর বাংলাদেশ থেকে ২০০টন এবং জাপান ৩০০টন অপরিশোধিত মধু আমদানী করে। এছাড়া দেশের আহরিত মধু যেসব দেশে রপ্তানী করা হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- স্পেন, চিন ও মধ্য প্রাচ্যের দেশ সমূহ। বাংলাদেশের আহরিত মধু ইতোমধ্যে জার্মানীর ইন্টারটেক ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষায় এর গুনগত মান ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাহিদা ভিত্তিক গুনগত মান সম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়েছে। পরে স্লোভেনিয়া কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমানে আমদানী করায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে প্রবেশাধিকার পেয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। জেলায় ৭৯ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮১ হাজার ৫৪০ হেক্টরে চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ হাজার ১২০ হেক্টর। গত মৌসুমের চেয়ে এবার ২৩ হাজার ৪২০ হেক্টর বেশি জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মৌ চাষের আওতায় জমি রয়েছে ১৮ হাজার ৮২ হেক্টর। মৌ বাক্স স্থাপিত হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭টি। এ পর্যন্ত জেলায় স্থানীয় ৩৪ জন ও অস্থায়ী ৭৮ জন মোট ১১২জন মৌচাষি পাঁচ হাজার ৯১৭ কেজি মধু আহরণ করেছেন।

সূত্রমতে, গত বছর কৃষকরা সরিষার ভালো দাম পেয়ে লাভবান হয়েছিলেন। এ বছরও অধিক লাভের আশায় সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও অনেক কৃষক সরিষার আবাদ করেছেন।

টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সরিষাক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় বাক্স বসানো হচ্ছে। এলাকার দিগন্তব্যাপী সরিষা চাষে হলুদের সমারোহে মৌবাক্স স্থান করে নিয়েছে। মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণের ফলে সরিষার ফলনও বাড়ছে।

সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে হলুদের সমারোহ। স্থানীয় কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষাবাদ করেন। বছরের নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সরিষর বীজ বপণ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে জাতভেদে ৭০-৯০ দিন সময় লাগে। এ সময়ে কৃষকরা একদিকে সরিষা ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন। অন্যদিকে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মৌচাষিরা মধু আহরণ করছেন।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার সোনাতলা এলাকার মৌচাষি খলিল গাজী মধু আহরণ করতে এসেছেন। তিনি জানান, ১৩০টি বাক্স থেকে তিনি ৩০-৩৫ মণ মধু আহরণ করতে পারবেন। দেড় মাস এখানে থাকবেন। দেড় মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হবে। ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার মধু বিক্রি করতে পারবেন। পাইকারি বাজারে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা মণ দরে মধু বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। আহরিত মধু তিনি সরাসরি কোম্পানীতে দিয়ে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করার আশা করছেন তিনি। তিনি জানান, মৌমাছির বাক্স বসালে সরিষার ফলন ভালো হয়। তাই ক্ষেতের মালিকেরা বাক্স বসাতে সহায়তা করেন। চাকুরির অবস্থা বর্তমানে ভালো না। তাই শিক্ষিত যুবকদের দিন দিন মৌ চাষে আগ্রহ বাড়ছে।

মৌ শ্রমিক চয়ন মিয়া জানান, তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পরিবার এখন আর খরচ চালাতে পারেনা। সেজন্য মৌবাক্সের কাজ শিখতে এসেছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে মৌবাক্স গড়ে তোলার আশা করছেন।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের মৌচাষি জাহিদ মিয়া জানান, সরকারিভাবে মৌচাষিদের মধু আহরণের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মধু সংরক্ষণ করতে পারলে মৌচাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবে।

আল আমিন নামে অপর এক মৌচাষি জানান, মৌ চাষে খরচ অনেক। বছরে ৭ মাস মধু হয়
না। এ সময় মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখতে চিনি খাওয়াতে হয়। এ বছর চিনির দামও বেশি। তাই লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক আগে থেকে মৌচাষ করছেন। সরকার সরাসরি মধু সংগ্রহের ব্যবস্থা করলে মৌচাষিরা বেশি উপকৃত হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) আহসানুল বাসার জানান, মৌমাছি সরিষা ক্ষেতের ফুলে ফুলে ঘুরে মধু আহরণ করে থাকে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই ক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন ন্যূনতম ২৫ শতাংশ বাড়ে। পাশাপাশি চাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হন। সরিষা চাষিরা মধু সংগ্রহকারীদের বাধা না দিয়ে আরও সহযোগিতা করেন। নানাভাবে মধু সংগ্রহকারীদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ বছর এক লাখ ৪০ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করা হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তিনি জানান, উদ্ভিদের পরাগায়নে মৌমাছির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্ভাবনাময় মৌ চাষের উপকারিতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। বেশি মানুষ মৌ চাষে উৎসাহিত হলে উভয় পক্ষই লাভবান হবেন।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়