প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৫, ২০২৪, ১০:৪০ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ৮:৪৯ অপরাহ্ণ
উজ্জ্বল অধিকারী: সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা বেলকুচিতে সদাগর এক্সপ্রেস লিমিটেড এর কুরিয়ার এন্ড পার্সেল সার্ভিসের এজেন্ট হিসেবে একটি শাখা এনেছিলেন রুহুল আমিন নামের এক ব্যাক্তি। যে পার্সেল এক থেকে দু'দিনে পৌঁছানোর কথা কিন্তু ৭ থেকে ১০ দিনেও পার্সেল না পৌঁছানো, ঠিকমতো পার্সেল না পাঠাতে পেরে বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হওয়াসহ নানান সমস্যা যেন লেগেই ছিল। এর সাথে ছিল অযাচিত আরেক ঝামেলা, এখান থেকে নিজ খরচে পণ্য নিয়ে জেলা শহরে গিয়ে জেলার শাখায় সকল পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসা।
এসব নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে মনোমালিন্য, ঝামেলা ও লাভের আশায় ব্যবসা শুরু করে লসের মুখ দেখায় মাত্র ৩ মাসের মতো শাখাটি চালিয়েই গুটিয়ে নিতে হয়েছে ব্যবসা। শাখাটির এজেন্ট নেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়েছিল ৩ লাখ টাকা জামানত। শাখাটি বন্ধ হওয়ার প্রায় ৬ মাস হয়ে যাবার পরে এতদিনে তাকে জামানতের সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ডেকেছে কতৃপক্ষ।
শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সরেজমিনে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেলকুচির মুকুন্দগাঁতী এলাকায় অবস্থিত সদাগর এক্সপ্রেস এর কুরিয়ার এন্ড পার্সেল সার্ভিসের অফিস এলাকায় গিয়ে কোম্পানিটির কুরিয়ারে নিয়মিত পার্সেল পাঠানো ভুক্তভোগী, এলাকাবাসী, স্থানীয় দোকানদার, মার্কেটের মালিক ও বেলকুচি এজেন্ট নেওয়া রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে এসকল তথ্য উঠে আসে । বন্ধ হয়ে যাওয়া শাখাটির কার্যালয়ে বর্তমানে ঝুলছে কয়েকটি তালা। তবে সামনের প্রধান সড়কে এখনো লাগানো আছে একটি সাইনবোর্ড।
একসময় এই কুরিয়ার সার্ভিসটির মাধ্যমে অনেকটা নিয়মিতই নানান পণ্য পাঠাতেন বেলকুচি ইলেকট্রনিকস বাজারের ব্যবস্থাপক গৌরাঙ্গ ভৌমিক। তিনি বলেন, আমরা সদাগর এক্সপ্রেস কুরিয়ারে ঢাকাতে এয়ারকন্ডিশন (এসি) ও টেলিভিশন পাঠাতাম। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও পন্যটি ঢাকায় কাস্টমারের কাছে গিয়ে পৌঁছাতো না। দেখা যাচ্ছে আমরা এখান থেকে এক বৃহস্পতিবারে পাঠিয়েছি পরের বৃহস্পতিবার, শুক্রবার বা শনিবারেও সেই জিনিসটা সেখানে পৌঁছায়নি। তখন কাস্টমার আমাদের সঙ্গে রাগারাগি করত। বলতো, কোথায় পাঠাইছেন কিসে পাঠাইছেন যে এখনো পাই না, এখানে কি খরচ কম কিনা এসব। কিন্তু চার্জ কিন্তু অন্যান্য কুরিয়ারের মত একই ছিল, তারপরও সঠিক সময়ে জিনিসটা পৌঁছেনি।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে এখানে কুরিয়ার সার্ভিসে যোগাযোগ করা হলে তারা বলতেন- আমাদের সার্ভিসে সমস্যা হয়েছে, গাড়ির সমস্যা হয়েছে, সিজনের সমস্যা এসব কারণে মাল ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যদিকে অন্যান্য সব কুরিয়ার সার্ভিসে কিন্তু আজকে পাঠালে কালকেই সেটা ওখানে পেয়ে গেছে।
যেখানে বেলকুচি সদাগর এক্সপ্রেস লিমিটেড কুরিয়ার এন্ড পার্সেল সার্ভিসের শাখাটি ছিল তার পাশেই মোটর মেকানিক এর ঘর। তার চোখের সামনেই মাস তিনেক চলেছে এই কুরিয়ার সার্ভিসটি। সেই মোটর মেকানিক আল আমিন বলেন, এখানে প্রধান সমস্যাটি ছিল সার্ভিসটির গাড়ির। তারা ঠিকমতো গাড়ি দিতনা যার কারণে লোকজনের মালামাল ঠিকমতো যেতোনা, আসতো না। যার ফলে মাঝে মাঝে লোকজন এসে কুরিয়ার সার্ভিসের সামনে চিল্লাচিল্লি করতো। তিনি কুরিয়ার সার্ভিসের লোকদের বরাত দিয়ে বলেন, তারা বলতো ঠিকমতো গাড়ি না আসায় এখানে বৃষ্টিতে আমার মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। আবার দূর থেকে গাড়ি আসতে সময় লাগে যার ফলে নানান সমস্যা হয়।
কুরিয়ার সার্ভিসটির ঠিক সামনেই রাস্তার ওপারে আশরাফুল আলমের কনফেকশনারির দোকান। তার দোকানে বসেই দেখা যেত কুরিয়ার সার্ভিসের প্রায় সব কর্মকাণ্ডই। আশরাফুল আলম বলেন, সদাগরের এক্সপ্রেস এর এই শাখাটি যথাসময়ে গ্রাহকের মাল আনতেও পারেনি পৌঁছাতেও পারেনি। যার ফলে গ্রাহকের ভোগান্তির কোন শেষ ছিল না। যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এখানে এসে গ্রাহকরা চিল্লাচিল্লি করত। এছাড়াও এদের রাস্তা থেকেই পণ্য হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগও ছিল। যার কারনে গ্রাহক আসাও কমে যাচ্ছিল। এর ফলে ঘর ভাড়া থেকে শুরু করে সবকিছু খরচ আর তিনি তুলতে পারছিলেন না। পরে তিনি বন্ধ করে দিলেন।
হাসান প্লাজা নামে যে মার্কেটটিতে সদাগর এক্সপ্রেসের বেলকুচি শাখাটি ছিল সেই মার্কেটটির মালিক মাহমুদুল হাসান বলেন, তিনি অনেক স্বপ্ন নিয়ে শাখা চালু করেছিলেন। তবে আমি যতটুকু জানি, তাকে একটি টার্গেট দিয়ে বলা হয়েছিল, আপনি টার্গেট ফিলাপ করলে আপনার এখানে সরাসরি সার্ভিসের গাড়ি দেওয়া হবে। এই শাখা নেওয়া ব্যক্তি সেই টার্গেটও পূরণও করেছিল, কিন্তু তারপরও তাকে গাড়ি দেওয়া হয়নি।
তিনি শাখাটির এজেন্টের বরাত দিয়ে বলেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এখান থেকে মালগুলো আগে সিরাজগঞ্জে নিয়ে যেতে হয় তারপরে সেখান থেকে আবার নানান জায়গায় পাঠাতে হয়। যদি এর মধ্যে কোন মাল হারিয়ে যায় বা কোন ক্ষতি হয় তাহলে এর দায়ভার কে নিবে।
এ ব্যাপারে কথা হয় সদাগর এক্সপ্রেসের বেলকুচি শাখার এজেন্ট যিনি নিয়েছিলেন সেই রুহুল আমিনের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে বলেন, আমার এখান থেকে পার্সেলগুলো গিয়ে সিরাজগঞ্জ শাখায় দিয়ে আসতে হতো। তারপরে আবার কোনও পার্সেল আসলে সেটা সেখান থেকে নিয়ে আসতে হতো। এর জন্য একদিকে যেমন বাড়তি সময় লাগতো অন্যদিকে আমার খরচও বেশি হত। এভাবে আসলে পোষাতে পারছিলাম না, লাভের জায়গায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলাম। যার কারণে আবেদন দিয়ে শাখাটি বন্ধ করে দিতে হলো।
তিনি আরও বলেন, তাদের সঙ্গে আমার এগ্রিমেন্টই (চুক্তি) হয়েছিল যে আমাকে সিরাজগঞ্জে মাল পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে এবং নিয়ে আসতে হবে। তবে মৌখিকভাবে একটা কথা হয়েছিল যে, কোরবানি ঈদের পরে তারা আমার এখানে সরাসরি একটা গাড়ি দিবেন। কিন্তু তাদের হয়তো পোষাবে না এ কারণে তারা গাড়ি দিতে পারেননি। পরবর্তীতে আমি আবেদন দিয়ে আমার এজেন্টটি বাতিল করি। এখন তারা আমাকে ফোন দিয়েছেন যে আপনার যে জামানত আছে সেটি রিটার্ন নিয়ে যেতে। যেহেতু এখান থেকে সরাসরি গাড়ি ছিল না তাই পার্সেল যেতে সময় লাগার ব্যাপারটা স্বীকার করলেও পণ্য হারানোসহ অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারে অস্বীকার করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সদাগর এক্সপ্রেস লিমিটেড কুরিয়ার এন্ড পার্সেল সার্ভিসের সিরাজগঞ্জ শাখার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক মো. জিকরুল হোসাইন বলেন, বেলকুচি শাখার যিনি এজেন্ট নিয়েছিলেন তিনি সিরাজগঞ্জে সকল পার্সেল পৌঁছিয়ে দিবেন এবং এখান থেকে নিয়ে যাবেন এই শর্তেই তিনি রাজি হয়ে শাখাটি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন পোষাতে পারেননি তখন এজেন্ট ছেড়ে দেওয়ার জন্য কোম্পানির নিকট আবেদন করেন। পরবর্তীতে তাকে অফিস থেকে ফোন দিয়ে তার জামানত ফেরত নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। তবে পণ্য হারানো বা অন্যান্য সকল অভিযোগ সত্য নয়।
সদাগর এক্সপ্রেস লিমিটেড এর কুরিয়ার এন্ড পার্সেল সার্ভিসের উত্তরবঙ্গের দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহিম হোসাইন বলেন, সদাগরের শাখা নেওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে, সেই শর্ত মেনেই তিনি চুক্তি করে একটি এজেন্সি এনেছিলেন। যেখানে উল্লেখ ছিল- তিনি সকল পন্য সিরাজগঞ্জ শাখায় এনে পৌঁছে দিয়ে যাবেন এবং এখান থেকে এসে নিয়ে যাবেন। পরে তিনি চালাতে না পারার কারণে শাখাটি বন্ধ করার আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতেই শাখাটি বন্ধ হয়। তার যে জামানত আছে সেই জামানত ফেরত দেওয়ার জন্য অফিস থেকে তাকে ফোন দেয়া হয়েছিল। তিনি মঙ্গলবারে গিয়ে জামানত ফেরত আনবেন।
এই হরতাল অবরোধের মাঝেও সাদাগর এক্সপ্রেস নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এমন কেউ কোন অভিযোগ দেয়নি যে তার পণ্যটি হারিয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, কুরিয়ার সার্ভিস নিয়ে কাজ করে সবকিছু হান্ড্রেড পার্সেন্ট (শতভাগ) এনসিওর (নিশ্চিত) করাটা খুবই ডিফিকাল্ট (কষ্টসাধ্য)। তবে অন্যান্য অভিযোগ সত্য নয়।