স্মরণে অধ্যাপক মোসলেমা খাতুন, এক বহুমুখী প্রতিভা
টাঙ্গাইল প্রতিনিধ: মোসলেমা খাতুন, যিনি বুদ্ধি ও মমতার আলোকবর্তিকা হিসাবে খ্যাত। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ৯৪ বছর বয়সে মায়াময় এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। তাঁর জন্ম বর্ধমানে ২৯ নভেম্বর, ১৯২৯ সালে। তৎকালীন সর্বভারতে প্রথম জীবনে একটি রক্ষণশীল কিন্তু সাংস্কৃতিক এবং একাডেমিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবারে বড় হয়েছিলেন এবং জ্ঞানার্জনের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন।
তাঁর সময়ের সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অধ্যাপক খাতুনের শিক্ষার যাত্রা ছিল অধ্যবসায় এবং মেধার এক অনন্য সমন্বয়। মুসলিম মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগের অভাব সত্ত্বেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে অটল দৃঢ়তায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কালনায়- বাবার পোস্টি য়ের সুবাদে। সেই যুগে তিনি এক অজানা অধ্যায়ে প্রবেশ করেন যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেন এবং কয়েকজন মুসলিম মেয়ের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন।
সব সামাজিক বাধা ডিঙিয়ে তিনি যখন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন তখন তার শিক্ষার যাত্রা একটি উল্লেখযোগ্য মোড় নেয়। ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিতে অগ্রগামী মহিলা ছাত্রীদের একজন হয়ে ওঠেন। যদিও চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু জ্ঞানের অন্বেষণ তাঁর জন্য আনন্দ এবং পরিপূর্ণতার উৎস হয়ে ওঠে। তাঁর একটি প্রতীক বান্ধবীদের সাথে একটি পর্দা ঘেরা রিকশায় প্রতিদিনের কলেজে যাত্রা।
শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা এবং শেখার উৎসাহ, অধ্যাপক খাতুন শিক্ষা যাত্রা চালিয়ে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকাকালীন তিনি ১৯৫১ সালে ইংরেজি সাহিত্যে তিনি স্নাতকোত্তর ক্লাসে একমাত্র মহিলা ছাত্রী ছিলেন- যা একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যে অগ্রগামী মনোভাবের পরিচয় দেয়।
অধ্যাপক মোসলেমা খাতুনের অবদান একাডেমিয়ার বাইরেও প্রসারিত ছিল। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য তার সমর্থন প্রদর্শণ করে- যার জন্য তাঁকে ‘ভাষা কন্যা’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়।
তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর শিক্ষকতার মতো একটি সম্মানজনক পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন। পরের প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের উপর একটি অমোঘ ছাপ রেখে যান। রাজশাহী সরকারি কলেজে তাঁর কর্মকাল থেকে ইডেন গার্লস কলেজ এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে তার সম্মানিত অবস্থানে তিনি কেবল একাডেমিক জ্ঞানই দেননি- মানবিক সহানুভূতির একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
শিক্ষাদানের প্রতি তাঁর আবেগ, বিশেষ করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ, ক্লাসরুমের সীমানা অতিক্রম করে।আগ্রহী শিক্ষার্থীদের মনকে আলোকিত করে এবং সাহিত্যে নিহিত সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞার জন্য গভীর উপলব্ধি লালন করে। তাঁর অসংখ্য কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও মিসেস খাতুন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও স্বল্পভাষী ছিলেন। তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি এড়িয়ে নিঃস্বার্থভাবে প্রত্যাশা ছাড়াই মানুষকে শিখিয়ে গেছেন।
প্রফেসর মোহাম্মদ নোমানকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পরও তিনি নির্বিঘ্নে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। মাতৃত্ব এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ত্যাগ, ভালবাসা এবং কর্তব্যের গুণাবলীকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সহানুভূতি এবং সততার একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।
আমরা যখন প্রিয় মোসলেমা খাতুনকে বিদায় জানাচ্ছি- আমরা উদারতা, শিক্ষা ও সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর অটল ভক্তির এবং আবেগের জীবন উদযাপন করি। যদিও তিনি আমাদের মাঝে আর বিচরণ করবেন না, তথাপি তাঁর চেতনা এবং আলোকিত জীবন ভবিষ্যত প্রজন্মকে বুদ্ধি, শিক্ষা এবং সমবেদনার মূল্যবোধ গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। শান্তিতে থাকুন, প্রিয় অধ্যাপক খাতুন- আপনার স্মৃতি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।