উজ্জ্বল অধিকারী: সিরাজগঞ্জে “কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জোড়দারকরণ” শীর্ষক প্রকল্পের সিরাজগঞ্জ জেলার অফিস-কাম ট্রেনিং সেন্টারের স্থাপনা নির্মানের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে চলছে নানা জটিলতা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জেলা আওয়ামীলগের সভাপতির নির্দেশে রঘুনাথপুর গ্রামবাসীর একমাত্র চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে জোরপূর্বকভাবে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেখানে স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
এ ব্যাপারে গ্রামবাসী বারবার বাঁধা দিলেও তোয়াক্কাকরেনি কেউই। অধিগ্রহণকৃত জমির পিছনে কারখানা তৈরি করার লক্ষ্যে মোনাস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি তাদের ক্রয় করা ৪২ বিঘা জমিতে যাওয়ার প্রবেশপথও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে মোনাস্টিল প্রাইভেটে লিমিডেট অধিগ্রহণকৃত জমির একপাশ বরাবর কারখানার চলাচলের জন্য ট্রাক ও যানবাহন জন্য ১৮ ফুট রাস্তা রাখার জন্য বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ দিলেও তারও কোন প্রতিকার পায়নি তারা।এদিকে রাস্তা না পেলে তাদের ক্রয়কৃত ৪২ বিঘা জমিই সম্পর্ন্ন অকোজো হয়ে পড়বে সেই সাথে চরম ক্ষতির সম্মখীন হবে তারা। সেই সাথে জমির মালিকের অধিগ্রহনের টাকা পরিশোধ না করেই চলছে স্থাপনা নির্মানের কাজ।সরকার পরিবর্তনের পর কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখলেও নতুন করে আবার নির্মাণ কাজ শুরু করেছে গণপুর্ত অধিদপ্তর।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়,সিরাজগঞ্জ সদরের উপজেলার শিয়ালকোর মৌজায় নলকা-সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাশে ২০ বছর আগে ৩২ শতক জায়গা ক্রয় করেন মোনাস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান নরুল ইসলাম মন্টু। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সেই জমির পিছনে কারখানা তৈরি করার উদ্দেশ্য ক্রয় করেন আরো ৪২ বিঘা জমি। এই জমিগুলোর পাশ দিয়েই রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দাদের চলাচলের জন্য একটি রাস্তাও নির্মাণ করে দেয় মোনাস্টিল লিমিটেড । আর ওই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করে রঘুনাথপুর গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। কিন্তু কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জোড়দারকরণ শীষক প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জ জেলার অফিস-কাম ট্রেনিং সেন্টার নির্মানের উদ্যেগ গ্রহন করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করা হয়। ৩ তলা ভবনবিশিষ্ট প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৭ কোটি টাকা।
সড়ক থেকে মোনাস্টিল প্রাইভেট লিমিটেড জায়গায় প্রবেশের মাথা থেকে ও গ্রামবাসীর চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে ২০ শতক জায়গা অধিগ্রহণ করেন ভুমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই নির্মান কাজের ঠিকাদারী নেন সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেএম হোসেন আলী হাসান। রঘুনাথপুর গ্রামবাসী ও মনোস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেড বাঁধা দিলেও জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন আলী হাসানের দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ ও হুমকি ধামকি দিয়ে চলাচলের রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়ে চলতি বছরের ৫ মে থেকে নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।
এই নিয়ে মোনাস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমেটেডের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল ইসলামের সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেএম হোসেন আলী হাসানের আন্তঃকোন্দল শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে মোনাস্টিল প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান নরুল ইসলাম মন্টু জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বারবার অভিযোগ দিয়েও পাননি কোন প্রতিকার। তবে জেলা প্রশাসক ১৮ ফুট রাস্তা রেখে কাজ করার জন্য চিঠি দেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে। সেই চিঠিরও তোয়াক্কা করেননি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। ৫ আগষ্ট হাসিনা সরকার পতনের পর নির্মাণ কাজটি বন্ধ থাকলেও নতুন করে গ্রামবাসীর একমাত্র প্রবেশপথ রাস্তা না দিয়েই আবারও কাজ শুরু করেছে। রাস্তা না দিয়ে কাজ করতে দেবেন না গ্রামবাসী এই নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে চলছে দ্বন্দ্ব । এর ফলে যেকোন সময় ঘটতে পারে অঘটন ।
রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বিপুল বলেন, আমাদের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতো। কৃষি অফিস করার জন্য কি উদ্দেশ্যে যে রাস্তা বন্ধ করে দিলো তা আমরা বলতে পারতেছি না। আমরা অনেক দূর্ভোগের মধ্যে পড়েছি, একটা রোগী নিয়ে আমরা হাসপাতালে যেতে পারি না,বাড়িতে ফিরতে পারি না। বেড়া দিয়ে রাস্তাটি সম্পর্ন্নভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া পিছনে কলকারখানা গড়ে উঠার কথা ছিল এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলেও কিছুটা হতো কিন্তু রাস্তা বন্ধ দেওয়ায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেলো।
রঘুনাথপুর গ্রামের আরেক বাসিন্দা রুপা বেগম বাসিন্দা বলেন, কয়েক হাজার মানুষ ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতেন। হঠাৎ করেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের চরম অসুবিধা পড়তে হচ্ছে। আমরা গ্রামবাসী কোন জায়গা দিয়ে চলাচল করবো। এর একটা প্রতিকার হওয়া দরকার।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা শিউলি বেগম বলেন, প্রায় ছয় হাজার লোকের বসবাস এই গ্রামে। যাতায়াতের জন্য এ রাস্তা ছাড়াও অন্য কোন রাস্তা নেই। পায়ে হাঁটার জন্য মোনাস্টিলের মালিক নুরুল ইসলাম মন্টু একটি রাস্তা করে দিয়েছিল। কিন্তু কৃষি অফিস করার জন্য রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রামের কোন একটা রোগী যদি অসুস্থ্য হয় তাহলে অনেক দূর দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। যদি এখানে রাস্তা দেওয়া হয় তাহলে যানবাহন দিয়ে সহজে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি এখানে রাস্তা যেন বন্ধ করে না দেওয়া হয়।
মোনাস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজার আব্দুল মান্নান আকন্দ বলেন, এখানে ৪২ বিঘা জমি কেনার মূল উদ্দ্যেশ্য হলো কলকারখানা গড়ে তুলে মানুষের কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি। কিন্তু কৃষি অধিদপ্তর জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে ওই ৪২ বিঘা জমিতে যাব কেমন করে আর কলকারখানাই করবো কেমন করে সেখানে গাড়ি যাওয়া কোন রাস্তা নেই।
মোনাস্টিল কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থপনা পরিচালক আশরাফুল মাখলুকাত বলেন, কারখানা নির্মানের কাজ বন্ধ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। রাস্তা বন্ধ করার ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক এ ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে নিয়ে ১৮ ফুট রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালককে তারা একটা চিঠি দেয়। কিন্তু অনেকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোন উত্তর আসেনি।
৫ আগষ্টের পর থেকে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেএম হোসেন আলী হাসান নিরুদ্দেশ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা তানিয়া তিথি চৌধুরী বলেন,আগে কি হয়েছে তা জানি না। ওই সময় যারা ভূমি অধিগ্রহণ করেছিল তাদের খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসা করেন। আমি নতুন কর্মকর্তা আমি এটা বলতে পারছি না। আমার কাছে লিগ্যাল কাগজপত্র আছে আমি সেই কাগজপত্র অনুসারেই তো কাজ করবো। আমি তো কারো মুখের কথায় কাজ কররো না। তবে ভূমি অধিগ্রহনের টাকার জমির মালিক না নিলেও এই জায়গার মালিক এখন আমরা। আমাদের নকশা মোতাবেক কাজ হবে। আমরা চাই যুক্তিগতভাবে এর একটি সমাধান হোক।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ গনপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মাহমাদুল হাসান বলেন, যেহেতু স্থাপনা নির্মাণের জন্য বিল্ডিং এর পাইলিং এর কাজ সমাপ্ত হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে আমাদের আর ডিজাইন পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ তোফাজ্জল হেসেন, গ্রামবাসীর এটা যৌক্তিক দাবী। রাস্তা বন্ধ করে কখনই কিছু করা যাবে না। আমি অতিদ্রুত এই বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি। এছাড়াও ১৮ ফুট রাস্তার জন্য একটি আবেদন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে দেয়া হয়েছিল। রাস্তার বিষয়ে একটি তদন্ত হয়েছিল ও বিভাগীয় পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। জমির মালিক যদি আবারো আবেদন করে তাহলে সরজমিনে আবারো পরিদর্শন করবো এবং সমাধান অবশ্যই করতে হবে। কারণ রাস্তা ছাড়া মানুষ চলতে পারে না।