উজ্জ্বল অধিকারী: সিরাজগঞ্জ সদরে হাজী আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মো. আশফাকুল আউয়াল আশফাককে (৩৫) অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর দেওয়ান শহিদুজ্জামান শুভ (৫০) নামে এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। এমনকি তাকে তদন্তের স্বার্থে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় হতবাক এলাকাবাসী।
গ্রেপ্তারকৃত শহিদুজ্জামান শুভ সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার মাসুমপুর উকিলপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরীজীবি দম্পতি দেওয়ান তোফাজ্জল হোসেন ও সেহেলী জাহানের পুত্র। আর মৃত আশফাক আওয়াল আশফাক পৌর শহরের নতুন ভাঙ্গাবাড়ি এলাকার আব্দুর রহিম ভোলা হাজীর ছেলে।
জানা যায়, ব্যবসায়ী শহিদুজ্জামান শুভ দুই সন্তানের জনক। তিনি স্থানীয় এঞ্জেল ফুডস্ নামে বিস্কুট কারখানার তিন মালিকের একজন। এছাড়াও দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি আইসক্রিম কোম্পানির স্থানীয় পরিবেশক। শুভ দীর্ঘদিন ধরে বেশ সুনামের সঙ্গে শহরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এঞ্জেল ফুডস্ বিস্কুট কারখানার পণ্য তৈরির জন্য দীর্ঘদিন ধরে একই এলাকার হাজী আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিল থেকে ময়দা ক্রয় করা হতো। মালিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্ক ভালো থাকায় বিভিন্ন সময়ে বাকিতেও ময়দা সরবরাহ করতেন আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক আশফাক। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বকেয়া টাকা চাইতে এঞ্জেল ফুডস্ কারখানায় যান আশফাক। তখন কারখানায় অবস্থান করছিলেন মালিক বাবু মন্ডল ও অপর মালিক শহিদুজ্জামান শুভ। এসময় দেনা-পাওনা নিয়ে কারখানার বাইরে আশফাকের সঙ্গে বাবু মন্ডলের তর্ক বিতর্কের একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে শুভ দেখতে পান, আশফাক হঠাৎ করে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে। যা দেখে ভয়ে তাৎক্ষণিক সেখান থেকে পালিয়ে যান বাবু মন্ডল।
এসময় দ্রুত আশফাককে উদ্ধার করে শহরের আভিসিনা হাসপাতালে নিয়ে যান শহিদুজ্জামান শুভ। পরে আশফাকের অসুস্থতা ও হাসপাতালে আনার তথ্য তার বোন জামাতা ডা: মো. মোহসেনুল মোমিনকে মোবাইলে কল দিয়ে জানান তিনি। কিছুক্ষণ পর তার বোন জামাতা হাসপাতালে আসলে আশফাককে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
পরবর্তীতে খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। এসময় তদন্তের স্বার্থে শহিদুজ্জামান শুভকে থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অদৃশ্য কারণে শুভকে রাতভর থানায় আটকে রাখা হয় এবং পরদিন হত্যা মামলায় দ্বিতীয় আসামি করে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
স্থানীয়রা জানায়, তিন ভাই বোনের মধ্যে শুভ মেঝো। তার বাবা জনতা ব্যাংকে চাকরির পর সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। মা সিরাজগঞ্জ সদরের মাসুমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া তার বড় বোন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং ছোট বোন দেশের প্রতিষ্ঠিত এক প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ইক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর। ফলে পারিবারিকভাবে, শিক্ষাগতভাবে, চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে এলাকায় শুভ'র বেশ সুনাম রয়েছে। তার মতো একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করবে এটি কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। আর সে যদি হত্যার সঙ্গে জড়িতই থাকত, তাহলে তো নিজে হাসপাতালে নিয়ে যেত না। এ ঘটনায় সঠিক তদন্তের দাবি জানান এলাকাবাসী।
তারা বলছেন, একটি পক্ষ প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। এমনকি এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
প্রতিবেশী মজিদ বলেন, শুভ অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র একজন মানুষ। আমি শুনেছি, ঘটনাটি ঘটেছে বাবু ও আউয়ালের মাঝে, শুভ উভয়ের উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন। আউয়াল অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই ঘটনায় শুভকে থানায় নিয়ে মামলা দেয়ার বিষয়টি অমানবিক।
রাজ্জাক বলেন, কতটা মানবিক হলে একজন মানুষ অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার পরিবারকে মোবাইলে কল দিয়ে জানাতে পারে। পরে শুনলাম তার বিরুদ্ধেই নাকি হত্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রতিবেশী ইউসুফ নামে আরেকজন বলেন, এটি হত্যা নাকি অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, সেটি পুলিশ নিশ্চিত না হয়েই কীভাবে শুভকে গ্রেপ্তার দেখালেন, সেটি তাদের বোধগম্য নয়।
ব্যবসায়ী শহিদুজ্জামান শুভ'র ছোট বোন বলেন, শুভ কেমন সেটি আমার চেয়ে এলাকাবাসীই ভালো বলতে পারবে। তার মতো এত সহজ সরল মানুষ বর্তমানে কমই আছে। এই সরলতার সুযোগ নিয়ে শুভকে পুলিশ ডেকে নিয়ে রাতভর আটক করে রাখে। অথচ পুলিশও স্থানীয়দের মাধ্যমে জেনেছে শুভই আশফাককে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, 'মূল ঘটনার সঙ্গে মামলার বিবরণের অসংগতি আছে। ওই ঘটনার সঙ্গে আমার ভাইয়ের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।’ এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও চক্রান্তকারীদের বিচার দাবি করছেন তিনি।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল আভিসিনা হাসপাতালে পৌঁছে আউয়ালের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। এসময় তিনি বলেন, আমরা সবকিছু জানলেও অনেক সময় কিছু করতে পারিনা, পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে আসামি করা হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2024 সংবাদের আলো. All rights reserved.