বুধবার, ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

শেরপুরে একই সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধে

জাহিদুল খান সৌরভ, শেরপুর প্রতিনিধি: শেরপুরে কলেজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একটি এমপিওভুক্ত কলেজে চাকরি করেও অন্য একটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এনিয়ে এলাকাতে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, পাঠদানে বোর্ডের স্বীকৃতি, এমপিওভুক্তি করণ ও কলেজের ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিযয়েছেন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।

এছাড়াও টিউশন ফি’র ৪লাখ ৭২হাজার ৫শ টাকা প্রতিষ্ঠানের একাউন্ট থেকে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ওই শিক্ষকের নাম মো. শাহিনুর ইসলাম। সে ঝিনাইগাতি মহিলা আদর্শ ডিগ্রী কলেজের গ্রন্থাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন। তার এমপিও ইনডেক্স নাম্বার ডি ৩০০৫৫২৭। অপরদিকে জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার ভারুয়া গ্রামে সীমান্ত মডেল কলেজে সে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব অনিয়ম ধরা পরায় দুই বছর আগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে নিজ হাতে লেখা আবেদনে পদত্যাগও করেন তিনি।

তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দুইদিন পর ৭ আগস্ট কলেজের তালা ভেঙে প্রবেশ করে স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে শুরু করেছেন তার পূর্বের রাম রাজত্ব। এতে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম। তবে প্রশাসনের পক্ষে থেকে দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কলেজ নথিপত্র দেখে এবং স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় সীমান্ত মডেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে যোগদান করে শাহিনুর ইসলাম। এরপর কখনও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, কখনওবা পাঠদানে বোর্ডের স্বীকৃতি, আবার কখনও এমপিওভুক্তি করণ ও কলেজ ভবন নির্মাণের কথা বলে

শুরু করেন শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ। দীর্ঘ কয়েক বছর পরেও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়া এবং ম্যানেজিং কমিটিসহ অন্যান্য শিক্ষকদের খরচের হিসাব না দেওয়ায় সন্দেহ শুরু হয় শিক্ষকদের মধ্যে।পরে ২০২২ সালের ২০মার্চ প্রতিষ্ঠানটির ১৯ শিক্ষক-কর্মচারী বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির কাছে লিখিতভাবে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অপসারণের আবেদন করেন। সে সময় ১৯ জন শিক্ষক ও কর্মচারীর মধ্যে ১৬ জনই সেখানে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের হিসাব দিতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করে চলে যান আলোচিত শাহিনুর।

তবে গত ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর নিজেকে বিএনপির লোক দাবি করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে শাহিনুর। এর ধারাবাহিকতায় ৭ আগস্ট সকালে একদল লোকজন সাথে নিয়ে সীমান্ত মডেল করেজে এসে অফিস পক্ষের তালা ভেঙ্গে প্রবেশ করে অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করেন তিনি। এরপর থেকেই বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে কলেজে ঢুকতে দিচ্ছেন না। এরপর গায়ের জোরে স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে দিব্বি কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

অভিযোগ আছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে অগ্রণী ব্যাংক, তিনানী বাজার শাখায় প্রতিষ্ঠানের যৌথ স্বাক্ষরিত একাউন্ট থেকে সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে ৪লাখ ৭২হাজার ৫শ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির  সভাপতি মো. মজিবুর রহমান বাদী হয়ে বিজ্ঞ সি.আর আমলী ঝিনাইগাতী, শেরপুর আদালতে একটি মামলাও দায়ের করেন। যার নাম্বার ২৪৬/২০২৪। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের তালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানের ড্রয়ারে রাখা ২৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর যোগদান পত্র, শিক্ষার্থীদের মার্কশিট, সনদ এবং নগদ ৫০হাজার টাকা লোপাট করার অভিযোগে বিচার চেয়ে শেরপুর জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুর রহমান।

এতে কোন সুরাহা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিজ্ঞ সি.আর আমলী ঝিনাইগাতী, শেরপুর আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যার নাম্বার ২৪৫/২০২৪। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী মো. মুক্তার হোসেন বলেন, আমি প্রধান সহকারী হওয়া সত্তে¡ও প্রতিষ্ঠানের কোন কাগজপত্র ধরতে দেয়নি সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহিনুর ইসলাম। ভর্তি, ফরম ফিলাপ ও রেজিস্ট্রেশনের সব কাজ তিনি নিজেই করতেন। এমপিও ও স্বীকৃতির জন্য কয়েক ধাপে তাকে আমিও টাকা দিয়েছি।

আমাদেরএমপিওভুক্তিও হয়নি, টাকাও ফেরত দেয়নি। তিনি নিজেই রিজাইন দিয়ে চলে যাওয়ার পরেও সরকার পরিবর্তনের পরে আবার এসে আগের খেলা শুরু করেছে। আমরা এর সমাধান চাই। ওই কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. শাহজালাল বলেন, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমি এই কলেজে কাজ করছি। কলেজ প্রথমে ভালোভাবেই চলছিলো। কিন্তু এমপিও’র জন্য অন্যান্য শিক্ষকের মত আমার কাছ থেকেও মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহিনুর রহমান। এখন আবার তালা ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠানে ঢুকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

কলেজে গেলে আমাদের নানাভাবে হুমকী দেখায়। তার ভয়ে অনেক শিক্ষক কলেজে যেতে সাহস পায় না। দ্রæত সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে এই সমস্যার সমাধান চাই। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুর রহমান বলেন, দুর্নীতি দায় নিয়ে ২০২২ সালে তিনি নিজ হাতে পদত্যাগপত্র লিখে এবং সবার সামনে তাতে স্বাক্ষর করে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের  দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম। গত ৭ আগস্ট তিনি তালা ভেঙ্গে কলেজে প্রবেশ করেন এবং আমাকে প্রাণনাশসহ নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছেন। এরপর থেকে আমাকে আর কলেজে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না তিনি। আমি প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার দাবি করছি।

এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতি মহিলা আদর্শ ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমার জানামতে একই ব্যক্তি দুইটি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার কোনো নিয়ম নেই। যদি এ বিষয় নিয়ে কোন আইনি জটিলতা তৈরি হয় তাহলে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কোথায় কাজ করবে। এছাড়াও তিনি বলেন, ঝিনাইগাতী আদর্শ মহিলা কলেজ থেকে লিখিতভাবে কোন অনুমতি নেননি। তাকে মৌখিকভাবে সেখানে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। লিখিতভাবে বা কমিটি রেজুলেশন করে তাকে অন্যত্র চাকরী করার কোনো অনুমতি দেয়নি। তবে একই সাথে দুই জায়গায় কিভাবে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন বা ক্লাস নেন এমন প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে যান।

কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মো. মজিবুর রহমান বলেন, আমি এই এলাকার হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করি। তৎকালীন গ্রামের মানুষসহ আমরা তাকে প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার দায়িত্ব দেই। কিন্তু কে জানতো সে এতো দুর্নীতিগ্রস্ত লোক। দায়িত্ব নিয়েই সে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পরে। অর্থ তছরুপ শুরু করে। এছাড়াও একই সাথে দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করারও কোনো বিধান নেই। পরবর্তীতে সে পদত্যাগ করে চলেও যায়। আবার সরকার পরিবর্তনের পর ৭ আগষ্ট নিজেকে বিএনপি’র কর্ম দাবী করে  কলেজে তালা ভেঙে অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করেছে। তাই দুর্নীতিগ্রস্ত ওই শিক্ষক এখানে না থাকুক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এটাই আমার চাওয়া।

এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এছাড়াও নীতিমালা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাজ করার কোন সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান। যদি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি এমপিওভুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবে না। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সুরাহা করতে না পারলে প্রয়োজনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

তবে অভিযুক্ত শিক্ষক মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলাম। পরবর্তীতে সকল শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মিলে আমাকে জোর করে তারিখ বিহীন কাগজে অব্যহতিপত্র নেয়। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে করা অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ গুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়