প্রিন্ট এর তারিখঃ অক্টোবর ৩০, ২০২৪, ৭:২৭ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ মে ২০, ২০২৪, ৯:০৬ অপরাহ্ণ
সংবাদের আলো ডেস্ক: বহুজাতিক ভিসা প্রোসেসিং সার্ভিস সংস্থা ভিএফএস-এর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ইউরোপের শ্রমবাজার। ইউরোপে গমনেচ্ছুক লক্ষাধিক বাংলাদেশির আবেদনসহ পাসপোর্ট আটকে রেখেছে সংস্থাটি। এক থেকে দেড় বছর ধরে এসব পাসপোর্ট আটকে থাকার কারণে একদিকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে ভুক্তভোগীরা, অন্যদিকে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। জানা গেছে, লক্ষাধিক পাসপোর্ট আটকে থাকায় এক বছরে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ভিএফএসের এমন কর্মকান্ডকে ইউরোপের শ্রমবাজার ধ্বংসে গভীর ষড়যন্ত্র বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে, দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন'। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশে ইতালি দূতাবাস ভিএফএস গ্লোবালের সঙ্গে ভিসা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা নির্দিষ্ট ফি-র বিপরীতে সম্পাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০০১ সালের পর ইতালি সরকার বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া বন্ধ রাখে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে ২০২০ সালের পর থেকে বাংলাদেশিরা ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগ পায়। এ সুযোগটি গ্রহণে ইতালিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। কেননা ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালি সরকার বিশ্বের ২০-২২টি দেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৮২ হাজার ৭০৫ জনকে ওয়ার্ক পারমিট দেয়। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশিরা পায় ৩০ হাজারেরও বেশি।
ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশের মালিক নাহিদ নেওয়াজ। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানাতে চান নি।
সূত্র জানায়, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর ভিসা প্রদানের সাক্ষাৎকার এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমার সিরিয়াল পেতে আবেদনকারীরা ভিএফএসের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রদানে ভোগান্তি, দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাণিজ্য, লক্ষাধিক পাসপোর্ট এক থেকে দেড় বছর ধরে আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে ভিএফএস। বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়াসহ অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতা রয়েছে।
বাংলাদেশে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসির নিয়ম অনুযায়ী ভিসার আবেদনের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। ভিএফএস গ্লোবাল গত বছর মে-র পর থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা তৈরি করছে। কোনো ব্যক্তি দালাল এবং মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান না। এদিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। কেননা ইতালির আইন অনুযায়ী ওয়ার্ক পারমিটসহ ভিসার আবেদনপত্রটি ওয়ার্ক পারমিট বের হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে অবশ্যই উপস্থাপন করতে হবে।
অথচ অ্যাম্বাসি সরাসরি আবেদন গ্রহণ করে না এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতায় পড়ে অনেকেই ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ হারাচ্ছে। তাছাড়া বিগত সময়ে ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত ৩০-৪০ হাজার আবেদনকারী পাসপোর্টসহ ভিসার আবেদন ভিএফএস গ্লোবালে জমা দিয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ ইতালিয়ান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আবেদন দাখিলের ২০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে ভিসা প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।'
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতালিতে বাংলাদেশিদের ভালো অবস্থান এবং সুনাম থাকার পরও বর্তমানে মালিকরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আবেদন করতে ইতোমধ্যেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ভিসা প্রদানের জটিলতা হচ্ছে। আমরা ওয়ার্ক পারমিট বের করে দিলেও সময়মতো শ্রমিক এখানে আসতে পারে না। আমাদের কাজের ক্ষতি হয়। অর্থাৎ ইতালির শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুযোগ প্রায় ধ্বংসের মুখে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। কেননা, ইউরোপে একমাত্র ইতালিতেই দক্ষ, অদক্ষ ও নিরক্ষর লোকও গিয়ে কাজ করার জন্য আবেদন করতে পারে। এই মানুষগুলো ইতালিতে যাওয়ার সুযোগ পেলে পরিবার এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং সে তার জীবনমান পরিবর্তন করতে পারে।
জানা গেছে, ভিএফএস গ্লোবাল ভিসা প্রসেসিং খরচ বাবদ জনপ্রতি ১৯ হাজার ৭২০ টাকা থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ভিসাপ্রত্যাশীরা কাগজপত্র জমা এবং সাক্ষাৎকারের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বুকিং বা অ্যাপয়েমেন্ট গ্রহণ করে থাকে। ২০২২ সাল থেকে এ অ্যাপয়েন্টমেন্ট সহজলভ্য হলেও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য কালোবাজারি এবং ভিএফএসের যোগসাজশে একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ভিসাপ্রত্যাশীরা নিজে চেষ্টা করে কোনোভাবেই ওয়েবসাইটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারে না। ভিসাপ্রত্যাশীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেলেও ভিএফএস কমকর্তা এবং দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সহজেই যখন-তখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করে থাকে।'
সূত্র জানায়, ভিসাপ্রত্যাশীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয় না। আবেদন গ্রহণ করার পর কোনো আপডেট তারা আবেদনকারীকে প্রদান করে না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে পাবে, তাদের পাসপোর্ট এতদিন আটকে রাখার কারণ, আদৌ ভিসা সরবরাহ করা হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব ভিএফএস বা দূতাবাস সরবরাহ করে না। এমনকি ভিএফএসের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য খুদেবার্তা ছাড়া আর কোনো মাধ্যম নেই। ফলে মাসের পর মাস এমন দোটানায় পড়ে নাজেহাল হয় আবেদনকারী বা তার পরিবার। সূত্র মতে, ভিএফএসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতার কারণে অনেক ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং দীর্ঘ সময় পর টাকার বিনিময়ে জমা দিলেও রিজেক্ট হয়েছে। ফলে ভিসাপ্রত্যাশীদের ১৮-২০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে এবং টাকাগুলো আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ভিএফএসের ওয়েটিং রুমে ভিসাপ্রত্যাশী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও হরহামেশা বেশকিছু দালালের বিচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে ভিএফএসের জিজ্ঞাসাবাদে নিতান্তই দায়সারা গোছের জবাব পাওয়া যায়।'
সূত্র জানায়, গত ৩১ মার্চ থেকে ভিএফএস মেইলিং সিস্টেমের মাধ্যমে অ্যাপয়েনমেন্ট নেওয়ার ঘোষণা দিলেও মেইলিং সিস্টেমে সিরিয়াল মেনটেনের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে একই অসংগতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। গত ৯ মে ভিএফএস চিটাগাং থেকে মেইলিং অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া ২০ জন আবেদনকারীর ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ৪০ জন মেসেজ পেয়েছেন বলে জানা যায়। যে অতিরিক্ত ২০ জন মেসেজ পেয়েছিলেন তাদের মেইলিং ডাটাবেজ চেক করে নানান ধরনের তথ্যের অসংগতি দেখা যায়। যার মধ্যে প্রধান অসংগতি হলো প্রটোকল ছাড়াই অতিরিক্ত ২০ জন অ্যাপয়েন্টমেন্টের কল পেয়েছিলেন।'
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অফিস চলাকালীন নির্ধারিত সময়ে ভিসা স্লট ওপেনিংয়ের নিয়ম থাকলেও গভীর রাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভিসা স্লট ওপেন করে ভিএফএস। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ২০২২-২০২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার পাসপোর্ট ভিএফএস আটকে রাখে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ৩৫ হাজার এবং ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়। এতে করে ভিসার খরচ, ভিএফএস খরচ, দালাল খরচ, রেমিট্যান্স বঞ্চিতসহ দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকা।'