ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের অনিয়ম ধামাচাপা
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের নানা অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষে পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা ও অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না করেই প্রকল্পের কাজ বুঝে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার নিমিত্তে নির্মিত ভবনগুলো ঠিকাদারদের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনের আলোকে নিয়োগকৃত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় মনিটরিং টিম (মনিটরিং কমিটি) ভৌত কাজের নিবিড় পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে। কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলাবস্থায় পরিবীক্ষণ করা হয়নি। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সভায় ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যূতি সংশোধনের শর্তে ভবন নির্মাণের সকল অনিয়মকে এক প্রকার বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
জানাগেছে, ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর একনেকের সভায় ৩৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ পায়। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে আরডিপিপি সংশোধন করে তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন, ১২তলা বিশিষ্ট একাডেমিক-কাম রিসার্চ ভবন, ১২তলা ভিতে ৬তলা পর্যন্ত শেখ রাসেল হল (৫৫০ ছাত্রের জন্য), ১০তলা বিশিষ্ট শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল (৭০০ ছাত্রীর জন্য), ১০তলা ভিতে পাঁচতলা পর্যন্ত সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তা কোয়ার্টার এবং পাঁচতলা পর্যন্ত মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ১৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাচুর্য়ালি যুক্ত হয়ে নব-নির্মিত ওই ছয়টি ভবন উদ্বোধন করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টেন্ডার ডকুমেন্ট ও পিপিআর-২০০৮ সম্পূর্ণভাবে অমান্য করে ৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭২ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বহির্ভূতভাবে রাজস্ব বাজেট থেকে অগ্রিম প্রদান করা হয়। বিষয়টি অডিট আপত্তিতে ওঠে এলেও কোন প্রতিকার হয়নি। ৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০তলা প্রশাসনিক ভবন, ১২তলা একাডেমিক ভবন, মাল্টিপারপাস ভবনের নির্মাণ- এই তিন ভবনের কাজ করে নূরাণী কনস্ট্রাকশন, আসবাবপত্র ক্রয়ের ঠিকাদারী পায় বনশিল্প কর্পোরেশন, ২য় ছাত্রী হল এবং সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তা কোয়ার্টার ভবনের কাজ করে মের্সাস ভাউয়াল কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৫৫০ ছাত্রের জন্য নির্মিত ১২তলা ভিতে ৬তলা পর্যন্ত শেখ রাসেল হল নির্মাণ করা হয়। ওই হলের নির্মাণ সংক্রান্ত কাজ বুঝে নেওয়া এবং নকশা ও ডিজাইন অনুসারে কাজের মান যাচাই-বাছাই পূর্বক সঠিক হয়েছে কি-না এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিনে নির্মাণ কাজ পরিদর্শন এবং শেখ রাসেল হলে এ বিষয়ে একাধিক সভা করে। সর্বশেষ গত বছরের ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় কমিটি রিপোর্ট প্রদানে সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত কমিটি প্রদত্ত রিপোর্টে ৩০ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করে কাজ বুঝে নেওয়ার কথা বলা হয়।
নির্মাণ কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য ম্যাটারিয়ালস এর ল্যাব পরীক্ষার টেস্ট ইনটেনসিটি/পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। নির্মাণ কাজের জন্য প্রাপ্ত কিছু ল্যাব পরীক্ষার টেস্ট রিপোর্ট কাগজপত্রে সন্তোষজনক বলা হলেও তা যথাসময়ে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়নি- যা তদন্ত কমিটির সুপারিশে জেরালোভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্মিত ভবনের দরজা-জানালার থিকনেস ইঙছ অনুযায়ী প্রতিটিতে প্রায় আধা ইঞ্চি পরিমাণ কম রয়েছে। ফায়ার ফাইটিংয়ের হোস পাইপ ইন্সটলেশনের জন্য করা অনেক ছিদ্র বন্ধ করা হয়নি। ভবনের ফাউন্ডেশন, বিম, কলাম ও দেওয়ালের গাঁথুনির কাজ খালি চোখে বুঝা যায়নি বিধায় এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ভবনের নানা আইটেমের পরিমাপ যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিকারের সুপারিশ করা হয়। কমিটির যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে নানাবিধ ৩০টি অসঙ্গতির উল্লেখ করে প্রতিকারের নিমিত্তে ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও- তা করা হয়নি।
সরকারের স্থানীয় সরকার বিধিমালা অনুযায়ী পৌর এলাকার অভ্যন্তরে সকল সরকারি/স্বায়ত্বশাসিত/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে পৌরসভা কর্তৃক নকশা অনুমোদন গ্রহণ করার বিধান থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল পৌরসভার কোন অনুমোদন নেওয়া হয়নি। নকশা অনুমোদন না নিয়েই প্রকল্পের আওতায় ভবনগুলোর নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়েছে। টাঙ্গাইল পৌরসভা বিশ্ববিদ্যালয়কে নকশা অনুমোদনের বিষয়ে দুইবার নোটিশ প্রেরণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক কোন কর্ণপাত করেনি।
নির্মাণকাজের অনুমোদন বিহীন নকশার কারণে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ প্রকল্পের মাল্টিপারপাস ভবনের ঢালাইকালে ক্যান্টিলিভার পোর্স ভেঙে ১৮ শ্রমিক আহত হয়। ওই সময় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নামেমাত্র তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় ঢালাইয়ের ত্রুটির কারণে সমস্যা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী ভবনের ডিজাইনের পরিবর্তন করে ক্যান্টিলিভার স্লাবের একটি কলাম সাপোর্ট প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় ভবনের ডিজাইনগত ত্রুটি রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি (পিআইসি) সভার সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে প্রকল্প সঠিকভাবে নির্মাণে প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ দেয়। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মোস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ২৪ জুন এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলের নির্মাণ সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ খাদেমুল ইসলাম জানান, তাদের ৭ সদস্যের কমিটির সদস্যরা সবাই একমত হয়ে ৩০ দফা সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন সিলগালা করে জমা দিয়েছেন। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষদ বলতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য প্রফেসর ডক্টর ফরহাদ হোসেন জানান, ছোট খাট ত্রুটি-বিচ্যূতি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ দ্বায়িত্বে করে দেবে মর্মে ভবনগুলো বুঝে নেওয়া হয়েছে। গত সপ্তায় রিজেন্ট বোর্ডের সভায় প্রকল্পের ভবনগুলো বুঝে নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডক্টর ফেরদৌস জামান জানান, প্রকল্পটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া এ বিষয়ে তিনি বেশি কিছু জানেন না।
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।