সংবাদের আলো ডেস্ক: ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে বিএনপি-আওয়ামীলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মারুফ শেখ। মারুফ নিহত হবার দীর্ঘ ১১ বছর পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে ফরিদপুরের আদালতে মামলা করেছেন নিহতের মা ছালেহা বেগম (ছলে)। মামলায় ৬৫ জনের নামউল্লেখসহ আরো ৫০/৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে।
এ মামলাটি দায়েরের পর বিএনপি ও আওয়ামীলীগের নেতাদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। মামলায় এমন ব্যক্তিকে আসামীর তালিকায় রাখা হয়েছে যিনি ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থান করছিলেন। অনেকেই সেইসময় ফরিদপুরেই ছিলেন না। তাছাড়া এমন ব্যক্তিকে আসামীর তালিকায় রাখা হয়েছে যারা তৎকালীন সময়ে এলাকা ও রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলনা। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিকেও আসামী করা হয়েছে।
অনেকেই এ মামলাটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের মামলা হিসাবে অবহিত করেছেন। মারুফ নিহত হবার পর তৎকালীন সময় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিল। সেই মামলায় বিএনপি-হেফাজত নেতাদের আসামী করা হয়। এবারের মামলায় বেশীর ভাগ আসামীই আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী।
স্থানীয় এলাকাবাসী, মামলার বিবরণী ও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালে বিএনপির ডাকা হরতালে নগরকান্দার জঙ্গুরদী বাস স্ট্যান্ডের কাছে সকালে পিকেটিং করার সময় আওয়ামীলীগের সাথে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় উভয় পক্ষের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
একপর্যায়ে পুলিশ আওয়ামীলীগ একজোট হয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করে। কয়েক ঘন্টা ধরে চলা পাল্টাপাল্টি এ সংঘর্ষে পুলিশ ১২৫টি টিয়ারসেল, ৬২০ রাউন্ড শর্টগানের কাতুজ, ২৮ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি করে। সেই সময় আওয়ামী ও যুবলীগের কয়েক নেতাকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় দেখা যায়। সংঘর্ষ চলাকালে ছাগলদি বাস স্ট্যান্ডর কাছে গুলিবিদ্ধ হয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মারুফ শেখ। পরে সে মারা যায়। মারুফ নিহত হবার ঘটনার পর পুলিশকে দায়ী করে বিবৃতি দেয় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতৃবৃন্দ। মারুফ নিহত হবার ঘটনায় নগরকান্দা থানা পুলিশের এস আই খলিলুর রহমান বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় আসামী করা হয় ১৪৬ জনকে।
যারা সবাই ছিলেন বিএনপি ও হেফাজত ইসলামের রাজনীতির সাথে যুক্ত। দীর্ঘ ১১ বছর পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিহতের পরিবারের তরফ থেকে আদালতে যে মামলাটি করা হয়, সেই মামলা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, এ মামলায় যাকে ৫নং আসামী হিসাবে দেখানো হয়েছে সেই মোঃ হাবিবুর রহমান ওরফে পান্নু মাতুব্বর ঘটনার সময় ছিলেন মালয়েশিয়ায়। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়া যাবার পর একটানা সেখানে থাকার পর দেশে আসেন ২০১৪ সালের ফেব্রয়ারিতে। অথচ তাকে এই মামলায় আসামী করা হয়েছে। মারুফ হত্যা মামলায় সেই সময় যে মামলাটি আদালতে রুজু করা হয়েছিল সেই খানেও নাম ছিলনা হাবিবুর রহমান পান্নুর। বিদেশে থাকলেও তাকে মামলায় আসামী করা হয়েছে।
মামলার বিষয়ে হাবিবুর রহমান পান্নু বলেন, তিনি ঘটনার সময় মালয়েশিয়ায় ছিলেন। মালেয়শিয়ায় বসে তিনি হত্যার খবর শুনেছেন। দেশে না থেকেও তাকে হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ মামলাটির বিষয়ে যারা ইন্ধন দিয়েছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। আমাকে সামাজিক ভাবে হেয় করতেই এ ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
মামলার আরেক আসামী আবু আব্দুল্লাহ বলেন, আমার পরিবার বিএনপির সাথে জড়িত। কেএম ওবায়দুর রহমান আমার বাবার বাল্য বন্ধু। আমি নিজেও পৌর যুবদলের সদস্য। আমাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে একটি পক্ষের ইন্ধনে। আন্দোলনের সময় খাবার ও অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করেছি। আওয়ামীলীগের আমলেও বিএনপির সভা হয়েছে আমার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্টানে। যার জন্য আমার উপর উপর চাপ প্রয়োগ হয়েছিল তৎকালীন সময়ে । জাতীয় নির্বাচনেও আমার একটি গোডাউন ছেড়ে দিয়েছি বিএনপির নির্বাচনী ক্যাম্প হিসাবে। বিএনপির একটি পক্ষ আমার উপর ক্ষুব্দ ছিল। আজ তারাই সুযোগ বুঝে আমার নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
তাছাড়া দীর্ঘদিন এলাকায় না থাকা ও ২০২০ সালে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া কাজী আব্দুস সোবহানকেও আসামী করা হয়েছে। কাজী আব্দুস সোবহানের দাবী, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তাকে হয়রানী করতেই মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তার দাবী, ঘটনার সময় তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন।
অভিযোগ উঠেছে, মামলায় এমন অনেককেই আসামী করা হয়েছে, যারা সেইসময় এলাকাতেই ছিলেন না। আর যিনি মামলার বাদী হয়েছেন তাকেও অন্ধকারে রেখে বিএনপির একটি পক্ষ এমন কাজটি করেছেন।
স্থানীয় বিএনপি একাধিক নেতা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিএনপির বিবদমান দুটি গ্রুপের কারনেই এ মামলাটির ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে তারা সন্দিহান। তাদের দাবী, বিএনপির একটি পক্ষকে ঘায়েল করাসহ অর্থনৈতিক সুবিধা পাবার আশায় কয়েক নেতা নিহত মারুফের মাকে দিয়ে মামলাটি করিয়েছে। এখানে বেশ কয়েক জনের নাম জড়ানো হয়েছে শুধুমাত্র ফায়দা লোটার জন্য।
সেই দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত চার জনের সাথে কথা হলে তারা জানান, সেই সময় সংঘর্ষে যাদের বিশেষ ভুমিকা দেখেছি, অথচ তাদের অনেকেই এ মামলায় নেই। এমন কয়েকজনকে জড়ানো হয়েছে যারা দেশে কিংবা এলাকাতেই ছিলেন না। বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী একনেতা জানান, মারুফ হত্যার পর সেইসময় আদালতে আমরা একটা মামলা দিয়েছিলাম। সেই মামলায় যারা আসামী ছিলেন তাদের অনেকের নাম বর্তমান মামলায় নেই। যদিও সেই মামলাটি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামীলীগ থানায় এজাহার ভুক্ত করতে দেয়নি। বর্তমানে নতুন মামলায় বেশকিছু নাম দেওয়া হয়েছে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।
এতে করে মারুফ হত্যার সুষ্ঠ বিচার নিয়ে সংশয়ে রয়েছি। মামলার বাদি ছালেহা বেগম (ছলে)’র সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান মুকুল বলেন, মারুফ হত্যার সুষ্ঠ বিচার আমরা চাই। আমরা চাইনা মারুফ হত্যা মামলাটি নিয়ে কোন রাজনীতি কিংবা বিতর্ক হোক। তবে মামলাটি দায়েরের বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার ছিল।
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2024 সংবাদের আলো. All rights reserved.