প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৮, ২০২৪, ১:৪১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ মে ১৭, ২০২৪, ৪:০২ অপরাহ্ণ
তেতাল্লিশ বছর আগে দেশে ফিরেছিলো বাংলাদেশ
সংবাদের আলো ডেস্ক : দেখতে দেখতে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তিপান্ন বছর পার করলো স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে ঘটে গেছে নানা ঘটনা দূর্ঘটনা। আছে সাফল্যের কথা সাথে আছে বেদনার উপাখ্যান। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনর্গঠনে ব্যস্ত ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে একদল ঘাতক তাঁর ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘটনাচক্রে বেঁচে যান বিদেশে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন ছুটি কাটাতে শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াসহ গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে। ড. ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল ছিল জার্মানি। উঠেছিলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সংবাদটি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও ড. ওয়াজেদ জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদের মারফত পান। এমন একটি ভয়াবহ সংবাদ তাঁদের কাছে শুধু চরম একটি বিয়োগান্তাক ঘটনাই ছিল না, অবিশ্বাস্যও ছিল।
বেলজিয়ামে অবস্থানকালে সবচেয়ে অমানবিক আচরণটি করেছিলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। তিনি জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ফোনে বলেন, তিনি যেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের তাঁর বাড়ি থেকে সত্বর নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনেকটা জোরপূর্বক বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার মতোই। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে বেলজিয়াম সীমান্তে পৌঁছে দিতে রাজি হন। এক রাতেই একটি দেশের জন্মদাতার পরিবারের একান্ত ঘরের মানুষ হয়ে যান গৃহহীন। এক কথায় উদ্ভাস্তু। জার্মানিতে অবস্থানকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মানিতে দায়িত্বরত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরির সহায়তায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে শেখ হাসিনাকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অনুরোধ করলে ইন্দিরা গান্ধী তাতক্ষণিক রাজি হয়ে যান। আগস্টের ২১ তারিখ শেখ হাসিনা দিল্লির উদ্দেশে জার্মানি ত্যাগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের মাতৃস্নেহে গ্রহণ করেন।
নিরাপত্তা বিবেচনা করে তাঁদের নাম বদলে নাম রাখা হয় মি. ও মিসেস মজুমদার। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি গবেষকের চাকরিরও ব্যবস্থা করে দেন। শেখ হসিনা প্রথমবারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই ঢাকার পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনতে পান। শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে তখন জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে মোটামুটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করে ফেলেছেন। শাহ আজিজের মতো চিহ্নিত রাজাকারকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। ঘাতক আবদুল আলিমকে বানিয়েছেন মন্ত্রীসভার সদস্য। জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসতে দিয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না বলে একটি ধারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে উচ্চ পদে পদায়ন করেছেন। পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান চালু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১১ হাজার পাকিস্তানি দালাল রাজাকার-আলবদর বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে ছিল।
জিয়া তাদের মুক্ত করে দেন। বাতিল করেন দালাল আইন। যে দেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, তাদের আত্মত্যাগকে জিয়া পদদলিত করেছেন।জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করেই আওয়ামী লীগের সব শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীকে জেলে পুরেন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অনেকটা ছত্রভঙ্গ। এই সময় দলের হাল ধরেছিলেন শহীদ তাজউদ্দীনের স্ত্রী বেগম জোহরা তাজউদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন দলের কিছু তরুণ নেতা। কিন্তু সবাই জানতেন দলকে নবজীবন দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর একজন উত্তরাধিকার। ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ড. কামাল হোসেন দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা দিল্লি গিয়ে শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরিয়ে আনেন। শেখ হাসিন দেশ ফিরবেন এই সংবাদ জানাজানি হয়ে গেলে জিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ি গঠিত হয় ‘শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধ কমিটি’। নেতেৃত্বে মির্জা গোলাম হাফিজ, জিয়ার আমলের সংসদের স্পিকার। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশে ফিরবেন এই সংবাদে দেশের মানুষ এমন উজ্জিবিত হয়ে উঠেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত মির্জা গোলাম হাফিজ তার কর্মসূচী বতিল করে ঘরে ঢুকে যান।
যেদিন শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন, তখন তা বঙ্গবন্ধু আর বাঙালির বাংলাদেশ ছিল না। যখন ফিরলেন তখন তা পরিণত হয়ে গিয়েছিল জেনারেল জিয়া আর পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের বাংলাদেশ। যে শেখ হাসিনার ১৯৭৫ সালে বিদেশ যাওয়ার সময় সব কিছু ছিল, সেই শেখ হাসিনা যখন স্বদেশ ফিরলেন তখন তাঁর কিছু নেই। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন সর্বহারা। এ রকম পরিস্থিতিতে যেকোনো মানুষের মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। হামলা। আল্লাহর রহমতে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে হতে সেই যাত্রায় শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেক সময় তিনি দলের অনেক নেতার সহায়তাও পাননি। শেখ হাসিনা তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরাধিকার। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন সরকার গঠন করেন, তখন বাংলাদেশ ছিল একটি নিম্ন আয়ের দেশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল চার শ ডলারের নিচে আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই বাংলাদেশে বর্তমান মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮০০ ডলারের বেশী আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমনে সাত গুন।
কৃষিতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রতত্তে্ব লিপ্ত, তখন এই শেখ হাসিনাই সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থেই হবে। অনেকের সে কী ঠাট্টা! আজ সেই পদ্মা সেতু বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সামনের বছর তা চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনার পক্ষেই বলা সম্ভব এখন থেকে কোনো বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ তার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে তৈরি হলো সুড়ঙ্গপথ, যা ছিল মানুষের কল্পনারও বাইরে। সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু। সেই বাংলাদেশ এখন ২৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরূ হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে বাণিজ্যিক ভাবে সচল হবে রূপপুর। বাংলাদেশের উপগহ্র মহাকাশে ঘুরছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে মহাকশে যাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় উপগ্রহ। জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের সিঁড়ি অতিক্রম করার পথে।
২০৪১ সাল নাগাদ দেশটি উন্নত বিশে^র তালিকায় উঠে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার টানা চার মেয়দে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বাংলাদেশ এখন বিশে^ তেত্রিশতম অর্থনীতির দেশ। গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশ। একজীবনে একজন মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব, তা শেখ হাসিনা করে ফেলেছেন যদিও করতে পারতেন আরো অনেক কিছু। তাঁর সামনে সব সময় পথ আগলে দাঁড়িছে দেশের সবজান্ত সর্বনাশা আমলাতন্ত্র ও কিছু চাটুকার । তাঁর সামনে এই মুহূর্তে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা। এই ভয়াবহ রোগটি দেশের প্রশাসন যন্ত্রকে গিলে খেয়েছে। এটি করতে হলে যথাযথ মানুষকে যথাযথ জায়গায় পদায়ন করতে হবে। দেশটিকে অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে।
তার জন্য ধর্মীয় শিক্ষাসহ সব শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার।' শেখ হাসিনা এই দেশকে বিশ্বদরবারে একটি পরিচিতি দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। শেখ হাসিনা আরো দীর্ঘায়ু হোন এই প্রার্থনা করি। দেশকে দিয়েছেন তিনি অনেক কিছু। যা দিয়েছেন তার চেয়ে বেশী কিছু চাওয়াটা হয়তো সমীচিন হবে না। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করে চাওয়ারমতো এখন আর কাওকে দেখা যাচ্ছে না। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা নয়, দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ। ৭ মে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা যখন বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছিলেন, সেদিন গণতন্ত্র দেশে ফিরেছিল। তাঁর শাসনামলের সব অর্জন ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন যোগ্য মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন। আর জরুরী ভিত্তিতে দেশকে আমলাতন্ত্রের সর্বনাশা অভিশাপ হতে মুক্ত করা, দূর্নীতেকে সমূলে উৎপাটন করা। জয়তু শেখ হাসিনা। জয়তু বাংলাদেশ।
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2024 সংবাদের আলো. All rights reserved.