সংবাদের আলো ডেস্ক:বীকন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ এবাদুল করিম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। পতিত স্বৈরাচার সরকারের সাবেক এ সংসদ সদস্য হংকং ও দুবাইয়ে গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হংকংয়েই তার কোম্পানির আর্থিক মূল্য দেড় কোটি ইউএস ডলারের বেশি। ওই প্রতিষ্ঠানের হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনও হয় ব্যাপক। কোম্পানি রয়েছে দুবাইয়েও। লেনদেন করেন দুবাইয়ের মাশরেক ব্যাংকে। অনিয়মের এখানেই শেষ নয়। এবাদুল করিম শেয়ারহোল্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে খুলেছেন আলাদা কোম্পানি। জড়িত হয়েছেন শেয়ারবাজার কারসাজিতেও। আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের নামে বিও হিসাব খুলে তিনি বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। এমনকি এবাদুলের পিয়নরাও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন শেয়ারবাজারে। কালবেলার হাতে আসা এবাদুল করিম ও বীকন গ্রুপের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যবসার নামে বিভিন্ন খাতে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন এবাদুল করিম। বীকন গ্রুপের আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। তথ্য বলছে, হংকংয়ে ২০১৬ সালে বীকন এশিয়া প্যাসিফিক নামে একটি কোম্পানি খোলা হয়। এর ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ফ্ল্যাট নম্বর-২০০৪, ২০/এফ, বেল হাউস, ব্লক-এ, ৫২৫-৫৪৩, নাথান রোড, ইয়াও মা তি, কাউলুন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম রয়েছে মোহাম্মদ এবাদুল করিমের। তথ্য বলছে, বীকন এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ছাড়াই হংকংয়ে চালু করা হয়েছে। এর পেছনে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় দেড় কোটি ইউএস ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো। পরবর্তী সময়ে বীকন এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বীকন মেডিকেয়ার লিমিটেড। কালবেলার হাতে আসা নথিপত্র বলছে, হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকে নিয়মিত এই কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। এ ছাড়া আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বীকন গ্লোবাল অপারেশন (এফজেডসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। যার লেনদেন করা হয় দুবাইয়ের মাশরেক ব্যাংকে। জানা যায়, বীকন ফার্মা ২০১৩ সাল থেকে বিদেশে ওষুধ রপ্তানি শুরু করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি বৃদ্ধিও পায়। ২০১০ সালে দেশীয় বাজারে বীকন প্রায় সাড়ে ৫৫ কোটি টাকার ওষুধজাতীয় পণ্য বিক্রি করে। ২০১৩ সালে এই বিক্রি দাঁড়ায় প্রায় ১২১ কোটি টাকা। ওই বছর বীকন বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করে প্রায় ২ কোটি টাকার। এরপর ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পায় রপ্তানিও। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিদেশে প্রায় ৪৪২ কোটি টাকার ওষুধ পণ্য রপ্তানি করে বীকন। এর পর থেকে বীকন ফার্মার ব্যানারে আর ওষুধ রপ্তানি করা হয়নি। পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে বীকন মেডিকেয়ার লিমিটেডের নামে। কোম্পানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, বীকন মেডিকেয়ার লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির সব পরিচালক এবং দায়িত্বশীলরা এবাদুল করিমের নিকটাত্মীয়। ফলে লাভের অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন না করে নিজেদের মধ্যে রাখতেই চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়। তথ্য বলছে, শেয়ারবাজারে কারসাজিতেও জড়িত রয়েছেন পতিত স্বৈরাচার সরকারের সংসদ সদস্য এবাদুল করিম। অন্তত ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি এ কারসাজিতে জড়ান বলে তথ্য মিলেছে। একই সঙ্গে এবাদুল করিমের বিপুল বিনিয়োগও রয়েছে শেয়ারবাজারে। কালবেলার হাতে আসা অন্তত ৫০টি বিও হিসাবের তথ্য বলছে, এসব হিসাব এবাদুল করিমের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার এবং স্বজনরা খুলেছেন। এর মধ্যে অনেকে এবাদুল করিমের পরিবারের সদস্য। শ্বশুরবাড়ির সদস্যরাও রয়েছেন। এ ছাড়া এবাদুল করিমের অফিসে যারা পিয়ন এবং নানা ছোটখাটো কাজে যুক্ত রয়েছেন, তাদের নামেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ-সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত এবং নথি পেয়েছে কালবেলা। বীকনের শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি)। সম্প্রতি বীকন ফার্মার শেয়ারদর প্রভাবিত করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ আজাদ হোসের পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে সিকিউরিটি আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ কারণে তাকে ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তথ্য বলছে, আজাদ হোসেন পাটোয়ারী বীকনের এমডি এবাদুল করিমের পিয়ন হিসেবে কাজ করেন। আজাদ পাটোয়ারী ২০২০ সালে প্রায় ১৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন শেয়ারবাজারে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে। এবাদুল করিমের আত্মীয় আকতার হোসাইন এমটিবি সিকিউরিটিজ কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। অন্য এক নিকটাত্মীয় সোহেল আলম একই সিকিউরিটিজ কোম্পানির মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। জানতে চাইলে বীকন ফার্মার সিএফও মো. জালালউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আপনি হংকংয়ে যে কোম্পানির কথা বলছেন সেটার নাম আমি শুনি নাই। দুবাইয়ের বীকন গ্লোবাল অপারেশনসেরও নাম শুনি নাই। সব মিথ্যা (অল দিস আর ফলস)।’ বীকন ফার্মার চেয়ারম্যান নুরুন নাহার করিম কালবেলাকে বলেন, ‘বীকন গ্লোবাল আর মেডিকেয়ার একই। বিপুল পরিমাণে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা পুরাই একটা ভুয়া কথা। আমাদের ঋণ করতে করতে শেষ হয়ে গেল। আমরা অসুস্থ হয়ে গেলাম।’ এইচএসবিসি, হংকং এবং মাশরেক ব্যাংক, দুবাইয়ে লেনদেনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কিছুক্ষণ লাইনে থাকার অনুরোধ করেন। এর কিছুক্ষণ পরে বলেন, ‘আমার সাহেব (এমডি মোহাম্মদ এবাদুল করিম) তো এখন বাসায় নাই। বাসায় আসলে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব।’ এই প্রতিবেদক বলেন, তাহলে আমি প্রশ্নগুলো করে রাখি, আপনি পরে উত্তর দিয়েন। এরপর প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘লাইনে থাকেন। আমার সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।’ পরে ফোন ধরিয়ে দেওয়া হয় মোহাম্মদ এবাদুল করিমের কাছে। তিনি সব প্রশ্ন শুনে কালবেলাকে বলেন, ‘আরে শোনেন, উল্টাপাল্টা কথা বলতেছেন। কোত্থেকে কী শুনছেন! দুবাইয়ের অ্যাকাউন্টে এক পয়সাও লেনদেন নাই। আর হংকংয়ের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হইছে। এই অ্যাকাউন্টটা করাই হইছে আমাদের এক্সপোর্টের বিজনেসটাকে… এভাবে তো ফোনে বলতে পারব না। আপনাদের সন্দেহ থাকলে আপনারা বাংলাদেশ ব্যাংকে কমপ্লেইন করতে পারেন। উনারা ইন্সপেকশন করতে পারে।’ শেয়ারবাজারে কারসাজি ও লোন নিয়ে স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক না, তথ্যগুলো সঠিক না।’
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2024 সংবাদের আলো. All rights reserved.