বৃহস্পতিবার, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়: তদন্ত কমিটি গঠন

জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: সিরাজগঞ্জের পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীন রুমির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ২৭টি চিত্র তুলে ধরে একটি লিখিত অভিযোগ সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার ও প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বরাবর দাখিল করেছেন কলেজটির ৩২ শিক্ষক ও কর্মচারী।

মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ইতোমধ্যেই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তদন্তে যা পাওয়া যাবে সেই আলোকেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এর আগে গত সোমবার (১২ আগস্ট) সকালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বিকেলেই পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিতে বাধ্য হন সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীন।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে তৎকালীন পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেনের উদ্যোগে সিরাজগঞ্জে পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১২ সালে কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলে কলেজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডিঙিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কণিষ্ঠ প্রভাষক খাদিজা পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়। কলেজটি নিজের কব্জায় নিয়েই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২০১৯ সালে সারাদেশের প্রায় হাজারের অধিক কলেজটি এমপিওভুক্ত করেন সরকার। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়।

অথচ কলেজটি এমপিওভুক্ত করার কথা বলে ১২জন প্রভাষকের কাছ থেকে ১,৭০,০০০/-(এক লক্ষ সত্তর হাজার) ও ৪জন কর্মচারীদের নিকট থেকে ৭৫,০০০/- (পচাত্তর হাজার) করে মোট ২১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। একই বছরে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের (সেশন-২০১৮-২০১৯) ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের (সেশন-২০১৯-২০২০) আইডি কার্ড বাবদ ১৬৫৯০/- এবং নেমটেক বাবদ ৭০৫০/- মোট ২৩৬৪০/- বিল উত্তোলন করা হয়। উক্ত সময়ে করোনা মহামরি থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের কোন উপকরণ দেননি। ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর অভ্যন্তরীন পরীক্ষার পুরাতন খাতা, বই বিক্রি করে টাকা অফিসে জমা না দিয়ে পুরো টাকাই তিনি আত্মসাত করেন। শিক্ষা উপকরণ কমিটিকে অবগত না করে তার স্বামী ও দেবরকে দিয়ে ঢাকা থেকে উপকরণ তৈরি করে কমিটির নিকট থেকে ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেন।

প্রতিষ্ঠানে নাচের শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতো এই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। অথচ তার নিয়োগের আগে বছরে ১৫ হাজার টাকা খরচ করেই সেই কাজগুলো করা হয়েছে। বিভিন্ন বই/গাইড প্রকাশনীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে নিম্নমানের বই/গাইড শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করেন তিনি।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীন রুমী কলেজের নতুন ক্যাম্পাসে মাটি ভরাটের জন্য কোন প্রকার টেন্ডার না দিয়ে নামমাত্র কমিটি দিয়ে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার ভাউচার করে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেন। এছাড়াও নতুন ক্যাম্পাসে ভবন তৈরিতে কোন টেন্ডার না দিয়ে নিজস্ব ঠিকাদারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ২৮ লক্ষ টাকার ভাউচার করেন। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বাবদ ঘড়ি ও দামী উপহার ক্রয় করে তার সন্তান ও স্বামীকে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার নিজেই ক্রয় করেন এবং নামমাত্র ক্রয় কমিটির কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে ভাউচারে স্বাক্ষর নেন। শিওরক্যাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বেতন আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিমাসে কমিশন নিয়ে সেটা আত্মসাত করেন। স্বেচ্ছাচারিতা ও মনগড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন শিক্ষকের জামানত টাকা আবার কোন শিক্ষকের আমানতের টাকা ও তিনি লিখে রাখতেন। তার এসব কারণে চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছেন শিক্ষকরা।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীন রুমী মিথ্যা তথ্য দিয়ে টেন্ডার আহ্বায়ন না করে প্রতিষ্ঠানের বাস নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে কয়েক কিস্তিতে টাকা আদায় করেছেন। রুটিন অনুযায়ী নিজের ক্লাস না নিয়ে অফিসে বসে দিনে রাতে তার ব্যক্তিগত ব্যবসা যেমন-জমি ক্রয়-বিক্রয়, ফ্লাট বিক্রয়, গাড়ী বিক্রয়ের কাস্টমারের সাথে সময় ব্যয় করতেন এবং প্রতিষ্ঠানের টাকায় তাদের ভারী আপ্যায়ন করতেন। একজন অধ্যক্ষ ১২ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কিন্তু তিনি নিজেকে ভারপ্রাপ্ত মনে না করে কলেজের মালিক মনে করেছেন। মাত্র ১৬ হাজার ৭’শ টাকার বেতনে চাকরি করে তিনি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের প্রিমিও গাড়ি ব্যবহার করেন। গড়েছেন মিল কারখানা কিনেছেন একাধিক জমি ও প্লট। এমনকি শ্রেণিকক্ষ ও অভিভাবকদের রুমের সংকট থাকা সত্ত্বেও তার গাড়ীর ড্রাইভারের জন্য শ্রেণিকক্ষে বেডিং ব্যবস্থা করে নেন এবং শ্রেণিকক্ষের সামনে গাড়ী রাখার গ্যারেজ তৈরি করেন।

প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছল অভিভাবকদের টার্গেট করে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট বিক্রির ধান্দা করতেন। কলেজ ক্যাম্পাসে নিজের ব্যবসায়ী কাজে ব্যস্ত থাকার বিষয়ে কোন শিক্ষক প্রতিবাদ বা অদক্ষতা ধরিয়ে দিলে সেই শিক্ষককে গালিগালাজ, অপমানজনক ভাষা প্রয়োগ, মিথ্যা শোকজ দিয়ে প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে শিক্ষকদের হয়রানী করতেন। শুধু তাই নয়, গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গোপন করে রেজুলেশন খাতার মাঝে ফাঁকা রেখে পরবর্তীতে মনগড়া কথা লিখে শিক্ষকদের বেতন কর্তন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেন। প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক কর্মচারীর বেতন ভাতার ক্ষেত্রে সমান অধিকার থাকার কথা সত্ত্বেও সভাপতির নাম ব্যবহার করে প্রাথমিক শাখার শিক্ষকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কোন নিয়ম ছাড়াই বাড়ী ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা না দিয়ে সামান্য বেতন দিয়েছেন। তার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কলেজের বেশ ক’জন সিনিয়র শিক্ষকের সাথে বেহায়াপনার আচরণ করে জোরপূর্বক তাদের সঙ্গে অশ্লীল করে ছবি তুলে ভয়ভীতি দেখিয়ে মানহানির মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। এমনকি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ছেলেকে ২০১২ সালে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকে শিক্ষকদের চাপ দিয়ে ভয় দেখিয়ে নিজে খাতা মুল্যায়ন করে ক্লাসে নিজের ছেলেকে ফার্ষ্ট বানাতেন।

এভাবেই এক পর্যায়ে স্বেচ্ছারিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে পারিবারকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নিয়ে যান। ফলে অনেক ভালো শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার অবমুল্যয়ন দেখে প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ করে ২৭টি অনিয়ম উল্লেখ করে একটি লিখিত অভিযোগ পুলিশ সুপার ও কলেজের সভাপতি আরিফুর রহমান মণ্ডল বরাবর দাখিল করেন শিক্ষকেরা। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) মো. জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন পুলিশ সুপার।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সুত্রধর ও মোঃ আবু সামা বলেন, বিগত ১২ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির পাহাড়সম অপরাধ করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীন রুমী। তিনি নিজেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনে না করে নিজেকে কলেজের মালিক মনে করেছেন। মাত্র ১৬ হাজার ৭’শ টাকার বেতনে চাকরি করে তিনি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের প্রিমিও গাড়ি ব্যবহার করেন। গড়েছেন মিল কারখানা কিনেছেন একাধিক জমি ও প্লট। অনিয়ম ও দুর্নীতির ২৭টি তথ্য লিপিবদ্ধ করে আমরা কলেজের ৩২জন শিক্ষক গত ১৫ আগস্ট কলেজের সভাপতি পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত আবেদন দিয়েছি। ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা অনিয়ম ও দুর্নীতির ন্যায় বিচার চাই। একই সঙ্গে আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খাদিজা পারভীনকে তার স্বীয়পদ থেকে অপসারণের দাবী করছি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত সিরাজগঞ্জের পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শিক্ষক মোছাঃ খাদিজা পারভীন রুমী অভিযোগের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবো বলেই মুঠোফোনটি কেটে দেন।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো মন্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো।

----- সংশ্লিষ্ট সংবাদ -----

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়